মানুষের জীবন বড় অদ্ভুত। কেউ হাসে, কেউ কাঁদে। প্রতিটি জীবনেরই আছে কিছু গল্প, কিছু কথা। পার্থক্য শুধু, সবার জীবনের গল্প কখনো এক হয়না। কারো জীবন তরী উত্তাল সমুদ্র পারি দেয় আবার কারো জীবন চোরাবালিতে আটকে যায়!
বছরের পর বছর শিকলে বন্দি হয়ে দিন কাটানো জয়া ঘোষের(২৫) জীবনটাও চোরাবালিতে আটকে গেছে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মা-বাবার আদরের জয়া আজ ৫ বছর ধরে শিকলবন্দী। মানসিক ভারসাম্যহীন জয়ার বিষয়ে পাড়া -প্রতিবেশীরা অভিযোগ করার পর থেকেই বাধ্য হয়ে জয়াকে শিকলে বেঁধে রাখেন মা।
জয়া মৌলভীবাজার সদর উপজেলার গিয়াসনগর ইউনিয়নের গ্রাম শ্রীমঙ্গল ঘোষ বাড়ির মৃত হরি ঘোষের মেয়ে । মা রেবা ঘোষের বয়স ৬৫ বছর। বৃদ্ধ মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে মেয়ের খাবার জোটান।
শৈশব পার করে কৈশোরে পা রাখতেই জয়ার মাঝে মানসিক কিছু সমস্যা দেখা দেয়। জয়ার বাবা বেঁচে থাকতে টুকটাক কিছু চিকিৎসা করিয়েছিলেন। তখন কিছুটা উন্নতি হলে একজন বোবা লোকের সাথে জয়ার বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের পর আবারও সমস্যা দেখা দিলে শশুর বাড়ির লোকজন জয়াকে বাবা-মা’র কাছে পাঠিয়ে দেন। কিছু দিনপর জয়ার বাবা মারা যান। এরপর আর টাকার অভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়ের জন্য হয়নি পর্যাপ্ত কোন চিকিৎসা। আজ পর্যন্ত জোটেনি প্রতিবন্ধী ভাতাসহ সরকারি কোন সহযোগিতাও। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে বড় ভাই অনুকূল ঘোষও(৪০) বিগত সাত বছর ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন।
জয়ার মা রেবা ঘোষ(৬৫) জানান, আমার বয়স হয়েছে, এখন নিজের চলতেই কষ্ট হয়। তারপরও নিজের দুটি ভারসাম্যহীন সন্তানের জন্য মানুষের বাড়িতে গিয়ে কাজ করছি। আজ পর্যন্ত কারো কাছ থেকেই কোন সাহায্য পাইনি।
অনুকূল ঘোষের স্ত্রী শুকতা ঘোষ(৩০) বলেন, আমাদের দুটি সন্তান। বাবা অসুস্থ থাকায় ছেলেটা পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়েছে আর মেয়েটা এখনও স্কুলে যাচ্ছে। পরিবারে দুজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ থাকায় ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ কেমন হবে, সে চিন্তায় ঘুম আসেনা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির থাকার ঘরের দরজাবিহীন একটি রুমে জয়া ঘোষকে শিকলে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। রুমের মেঝেতে বস্তা, চট আর পুরাতন একটি কাঁথা এবং মশারী টাঙানো। ঘরের ভেতর ঘুট ঘুটে অন্ধকার। নেই কোন বৈদ্যুতিক পাখা ও বাতি।
বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, জয়ার মা মেয়েকে ভাত খাওয়ানো শেষ করে হাতে দুটি ঘুমের ঔষধ নিয়েছেন। ঘুমের ঔষধ না খাওয়ালে রাতে জয়ার ঘুম হয় না। ঘরে ঢুকতেই জয়া দাঁড়িয়ে যায়। স্পষ্ট গলাতেই মায়ের সাথে কিছু কথা বলে।
অনাহার, অনিদ্রা আর অপুষ্টিতে চোখ দু’টি দেবে গেছে। শৈশবে সমবয়সীদের সাথে খেলাধুলা আর চতুর্দিকে ঘুড়ে বেড়ানো জয়া, বছরের পর বছর ধরে শিকল বন্দি হয়ে আলো বাতাস হীন বদ্ধ ঘরে এভাবেই আজ নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছে।
এ ব্যপারে মৌলভীবাজার সদর উপজেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা সুমন দেবনাথের সাথে যোগাযোগ করলে, তিনি বলেন, আমরা তাঁকে একটি প্রতিবন্ধী কার্ড প্রদান করে ভাতার ব্যবস্থা করব এবং চিকিৎসার প্রয়োজন হলে সদর হাসপাতাল বা সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে সেটিরও ব্যবস্থা করব।
স্থানীয় গিয়াস নগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মোশাররফ টিটু জানান, আমি মেয়েটির বিষয়ে কিছুই জানতাম না, এখন যেহেতু জানলাম আমি তাঁর জন্য একটি ভাতার ব্যবস্থা করব।
মির্জা গালিব বলেছিলেন, নিঃসঙ্গ জীবনের কোন গল্প থাকেনা, নিঃসঙ্গ জীবন কোন স্বপ্নও আঁকে না! হয়তোবা পর্যাপ্ত চিকিৎসা পেলে জয়াও নিঃসঙ্গ জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে ফিরে আসবে স্বাভাবিক জীবনে। শুনাবে তাঁর নতুন জীবনের গল্প, আঁকবে কোন স্বপ্নও!