লন্ডন: অনিয়মের বেড়াজাল মুক্ত হতে পারছে না দেশের ব্যাংকিং খাত। প্রকৃত উদ্যোক্তারা ঋণ না পেলেও যোগসাজশের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন গুটিকয় গ্রাহক। যাদের নিট সম্পদের পরিমাণের চেয়ে ঋণের পরিমাণ বহুগুণ বেশি। নামে-বেনামে এসব ঋণ পাইয়ে দিতেই যেন মরিয়া ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। পরিচালনা পর্ষদেও নিজেদের পছন্দের লোক বসানো হয়েছে। প্রভাবশালী এই মহলের ঋণ প্রস্তাবের বিরোধিতা করবে এমন সাহস দেখাবে কে?
কিন্তু যথেষ্ট জামানত কিংবা সম্পত্তি থাকার পরও প্রকৃত উদ্যোক্তাদের ঋণ পেতে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। যারা নিয়ম বহির্ভূতভাবে ঋণ নিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও চোখে পড়ে না।
ব্যাংকিং সূত্র জানায়, ব্যাংক থেকে অর্থ লুটপাটের ইতিহাস নতুন নয়। যুগে যুগে কোনো কোনো প্রভাবশালী শিল্প গ্রুপ ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নিয়েছে হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণ এক সময় খেলাপি হয়ে অবলোপনের খাতায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। আর একই ট্র্যাডিশন এখনো চলছে। এই মহল দেশে বৃহত্ অঙ্কের ঋণ গ্রহীতা হলেও সে তুলনায় দেশে ততটা কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। যদিও এদের অনেকেই বিদেশে বিনিয়োগ করেছে বিভিন্ন খাতে।
সূত্রমতে, দেশীয় একটি গ্রুপ সম্প্রতি একটি উন্নত দেশে হোটেলখাতে বিনিয়োগ করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে কয়েকশ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অর্থ স্থানান্তরে অনুমোদন নেওয়া হয়নি। বরং প্রবাসী বাঙালি কর্মীদের কাছ থেকে স্থানীয়ভাবে এসব অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে। এর বিপরীতে বাংলাদেশে সমপরিমাণ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। আমদানি ঋণপত্রের মাধ্যমে ওভার ইনভয়েসিং করে এসব অর্থ পাচারের বিষয়ও নতুন নয়। এ বিষয়গুলো সুষ্ঠু তদন্ত করলেই স্পষ্ট বেরিয়ে আসবে।
সূত্রমতে, যেসব ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে ওসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় পছন্দসই লোক বসিয়ে অতিমাত্রায় ঋণ গ্রহণের সুযোগও গ্রহণ করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে, যে দামে পণ্য আমদানি করা হয়েছে তারচেয়ে কম দামে দেশিয় বাজারে পণ্য বিক্রি করা হয়েছে। যা ধূম্রজালের সৃষ্টি করেছে। আর এ বিষয় এখন ব্যাংকিং খাতে রসালো আলোচনায় স্থান করে নিয়েছে। ‘উপরের’ নির্দেশ মোতাবেক কাজ করার অজুহাতে ব্যাংকারদের কেউ কেউ সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছেন। মাত্র এক—দেড়শ’ কোটি টাকা নিট সম্পদের বিপরীতে কোনো কোনো গ্রুপ নামে-বেনামে এত বেশি ঋণ নিয়েছে যা তদন্ত করলে সহজেই বেরিয়ে আসবে বলেও সূত্রটি দাবি করেছে।
জানা যায়, যেসব শিল্প গ্রুপ প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক থেকে সুবিধা নিচ্ছে তাদেরই একটি গ্রুপ অনেক ব্যাংকের শীর্ষ ঋণ গ্রহীতাদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। হালআমলে ব্যাংকিং খাতে মালিকানা পরিবর্তন নিয়েও নানা গুঞ্জন রয়েছে। বেসিক ব্যাংক, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপসহ বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনার পরও সংশ্লিষ্টদের টনক নড়ছে না। বরং সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি মেটাতে সরকার অর্থ যোগানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এভাবে বছরের পর বছর জনগণের আমানতের টাকা কিছু গ্রাহক নিয়ে নেবে আর সরকার ব্যাংকগুলোর ঘাটতি মূলধন মেটাবে, এমনটি আর কতকাল চলবে— এমন প্রশ্নও ঘুরেফিরে আসছে।
সূত্র মতে, পর্যাপ্ত সহায়ক জামানত থাকলেও কোনো কোনো উদ্যোক্তাকে বছরের পর বছর ঋণের জন্য ব্যাংকে ঘুরতে হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকে একটি কোম্পানির ঋণ প্রস্তাব শুধু শাখাতেই তিন বছর আটকে ছিল। পরবর্তীতে অফিস নির্দেশনা পরিবর্তন হলে ঋণ প্রস্তাবের ফাইলটি শিল্প ঋণ বিভাগে পাঠানো হয়। অথচ যখন প্রস্তাবনাটি তৈরি করা হয়েছিল তখন পণ্যমূল্য ও আনুষঙ্গিক ব্যয়ের খরচ যা দেখানো হয়েছিল, তিন বছর পর তা বৃদ্ধি পাওয়াই স্বাভাবিক। যদিও কোনো কোনো সূত্র বলেছে, একেবারেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ব্যাংক ঋণ পাওয়ার ঘটনা বিরল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্যাংকের পরিচালক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘উপর থেকে তদবির না করলে ঋণের জন্য জুতা ক্ষয় করেও লাভ নেই’। এই যখন ব্যাংকিং খাতের অবস্থা, তখন ব্যাংক খাত সংস্কার কার্যত কোনো সুফল বয়ে আনেনি বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ব্যাংক সংস্কার কমিশন গঠন ও তাদের সুপারিশ বাস্তবায়ন, বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে কোম্পানি করেও লাভ হয়নি। বরং দিনের পর দিন অবস্থা খারাপের দিকেই গেছে। ফিনান্সিয়াল ইকনোমিস্ট ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, কিছু বিশেষায়িত ব্যাংক ভালো করলেও সেগুলো ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত না করলে পুুঁজির যোগান প্রবাহে ভাটা পড়বে। অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাবও পড়বে।
এদিকে, ঋণ প্রদানে অনিয়মের বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা জরুরি বলে দাবি করেছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র। সূত্রটি মনে করে, এমনিতেই ব্যাংকিং খাতে নানা অনিয়ম নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। এসব অনিয়ম দূর না করলে লুটপাটের সেই ট্র্যাডিশন অব্যাহতই রয়ে যাবে, ব্যাংকিং খাতে সুশাসন আনা যাবে না। -ইত্তেফাক থেকে