সলিমুল্লাহ খান সাহেবের “সাম্প্রদায়িকতা : মুক্তনন রবীন্দ্রনাথও” আলোচনাটি পড়েছি। খুব সুন্দর ভাবেই নাতিদীর্ঘ গবেষণা তিনি করেছেন। যতটুকু তার বিষয়ে শুনেছি তিনি বাম রাজনৈতিক ধারার একজন গবেষক।
আমি কোন বিশাল ব্যক্তিত্ব নই, একজন অতি সাধারণ তবে সচেতন পাঠক হিসেবে তার নিবন্ধটি পাঠ করে আমি খুব উতসাহিত হতে পারিনি। প্রথম কারণ রবীন্দ্র নাথ সম্পর্কিত তার লিখাটি যতই সারগর্ভ বা সুখপাঠ হোক না কেন, কোন নমুনায়ই সময়োপযোগী নয়, অন্ততঃ আমার কাছে।
সময়ের উপযোগী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা সবকিছুতেই প্রজোয্য। জাতি হিসেবে এখন আমরা যে সময় অতিক্রম করছি, এ সময়, একজন সত্যিকারের প্রগতিশীল গবেষকের রবীন্দ্র নাথকে নিয়ে গবেষণামূলক আলোচনার সময় নয়। জাতীয়ভাবে রবীন্দ্রনাথ আমাদের কোন সংকট নহে। আর দেশের এ লগ্নে তাকে যদি কোনভাবে সাম্প্রদায়িক দেখানো যায় তা’হলে আমাদের অর্জনটা কি? আমার মতে অর্জন একটাই দেশের অভ্যন্তরে দাঁনা বেঁধে উঠা সন্ত্রাসী জঙ্গী আর মৌলবাদকে রাজনীতির সুবিধা পাইয়ে দেয়া। আর রবীন্দ্রনাথ সাম্প্রদায়িক ছিলেন এমনতর কথা নতুন কিছু নয়। বহু বহু আগে অনেকেই রবি ঠাকুরকে সাম্প্রদায়িক হিসাবে আবিষ্কারের গৌরব অর্জনের চেষ্টা করেছেন। লিখক, গবেষক যারাই জাতির, ইতিহাসের, সংস্কৃতির উতকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে লিখছেন অবশ্যই তাদের সময়ের দিকে নজর রাখতে হবে। সময়োপযোগী নাহলে এ ধরনের লিখা কালোজয়ী হওয়াতো দূরে থাক জাতির কাছে গ্রহনযোগ্যই হয় না। সংক্ষেপ করে বলে নেই, আমাদের মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ রবিঠাকুরের সাম্প্রদায়িকতা থেকে উতসারিত নয়।
ঠিক হোক আর যাই হোক আমাদের দীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম আর শেষমেষ মুক্তির যুদ্ধতো রবীন্দ্রনাথের চরিত্র বিচারের জন্য ছিল না। বরং রবীন্দ্রনাথকে নিয়েই দ্বিজাতি তত্ত্বের মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। তখন যদি রবীন্দ্রচরিত্র সাম্প্রদায়িক হয়েও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কোন ক্ষতি করতে সক্ষম হয়নি তা’হলে আজ কিভাবে এবং কেন সেই চরিত্র সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠলো? সে সময়, কে কি ছিলেন সেটা আমাদের কাছে বড় কথা ছিলনা এখনও নয়। আমাদের লক্ষ্য একটি সত্যিকারের আমূল অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ে তোলা। মানুষ সাম্প্রদায়িক হতেই পারে। সাম্প্রদায়িক হওয়াটা কোন অপরাধ বলে আমি মনে করি না। সাম্প্রদায়িকতাকে সামনে এনে দুষ্কৃতিপরায়নতা(সকল অর্থে) চরম শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
কে কি ছিলেন কিংবা কি করেছিলেন তা দেখার আগে প্রয়োজন অসাম্প্রদায়িক সমাজ কাঠামোর মজবুত নির্মাণ। যা আমাদের এখনও হয়ে উঠেনি। মানুষ মানুষই, ভিন গ্রহের জীব নয়। ভুল ভ্রান্তি মানুষের হবেই। সেই ভুল দেখেই এ দেশের কয়েককোটি মানুষ অসাম্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা এনেছে। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন ও যুদ্ধ যৌক্তিক ঐতিহাসিক কারণে জাতীয়তাবাদী হলেও আপামর নিরীহ সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা সেখানে প্রত্যক্ষভাবে ছিল এবং তা কোনধরনের ধনিক শ্রেণীর উষ্কানির কারণে যে ছিল তা’নয়। বরং খুবই স্বতঃস্ফূর্ত আর প্রগতিশীল রাজনৈতিক সমৃদ্ধির সূচক বা ধারক হিসেবে সমুজ্জ্বল জনঅংশগ্রহন ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী আমাদের প্রগতিশীল নেতৃত্ব সেই ধারাকে ধারণ করতে পারেনি বা ধরে রাখতে পারেনি। বরং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সুষ্ঠ চর্চ্চার বাইরে থেকে নব্য গড়ে উঠা লুঠেরা ধনিক শ্রেণী, শুধু দেশীয় নয় আন্তর্জাতিক মৌলবাদের আশ্রয়ে গিয়ে হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতাকে লুন্ঠন করে নেয়। রবীন্দ্রনাথের সাম্প্রদায়িকতা নয়।
রবীন্দ্র নাথেরও ভুল থাকতেই পারে। সর্বসাধারণের দৃষ্টিতে তার যে কাজকে আমাদের জন্য ভুল বলে ধরা পড়বে সেভুলগুলো বাদ দিয়ে রবীন্দ্রকে নিয়েই অতীতে আমরা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম আজও রবীন্দ্র সাহিত্য সংস্কৃতিকে নিয়েই আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাবো। বিগত ৪৪ বছরে আমাদের অনেক ভুলত্রুটি হয়েছে যার খেসারত গোটা জাতি মিলে এখনও দিয়ে যাচ্ছি। সলিমুল্লাহ সাহেবদের বলবো, মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে যে গবেষণা, তাকে মানুষ গ্রহন করে। অকল্যাণ বয়ে আনে এমন গবেষণাকে অবশেষে মানুষের ইতিহাস স্থান দেয় না। সলিমুল্লাহ মহোদয়ের রবীন্দ্র নাথ সম্পর্কিত অনেকটা নিখাদ তথ্য বিহীন লেখা দিয়ে তিনি সাময়িক কিছু জঙ্গি চরম ডান বামের বাহবা পেতে পারেন, হয়তো অর্থেরও সংস্থান হতে পারে কিন্তু অবশ্যই তা ক্ষণিক সময়ের। এনিয়ে এখানে এক বস্তা কিতাব রচনা করা যায় কিন্তু মানুষের পড়ার সময় নেই। তাই যেটুকু না বললে হয়না সেটুকুই বললাম। আর নতুন করে আমরা অকাজের বিতর্ক নিয়ে সময় নষ্ট না করে আসুন মূল কাজের দিকে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাই।