লন্ডন: বুধবার, ২৯শে চৈত্র ১৪২৩।। মানুষের মূল্যায়ন ছাড়া দেশ ও সমাজ সঠিক পথে আগাতে পারে না। একজন মানুষ যদি তার নিজের সমাজের জন্য কোন একটি ভাল কাজ করেন আর মানুষ তার স্বীকৃতি না দেয় তা’হলে প্রথমতঃ যা আমরা সকলেই জানি যে ওই ভাল কাজটি করার জন্য অন্য কেউ এগিয়ে আসবে না। দ্বিতীয়তঃ যিনি কাজটি করেছিলেন তিনি স্বীকৃতি না পেলে সমাজের দুষ্টপ্রকৃতির ভিন্ন মানুষ সেই কাজের মিথ্যা কারক হয়ে ভূয়া নেতা সেজে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করবে। এতে সমাজে সংকটের সৃষ্টি হয় যা দীর্ঘকাল অব্যাহত থেকে সমাজকে উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে দেয় না।
তৃতীয়তঃ একজন ভূয়া নেতা যখন স্বীকৃতি চাইবে তখন তার দেখাদেখি আরও দু’একজন নেতৃত্বের দাবী নিয়ে এগিয়ে আসবে, এটাই মানুষ সমাজে স্বাভাবিক। ফলে সংঘর্ষ হয়ে উঠে অবশ্যম্ভাবী। সমাজে দেখা দেয় অস্থিরতা, হানাহানি যা সমাজকে পঙ্গু করে রাখে দীর্ঘকাল। তাই সুস্থ সুশীল সমাজ উপযুক্ত কাজের স্বীকৃতি দেয় সময়মত নিজের অগ্রযাত্রাকে সমুন্নত রাখতে। এর ব্যত্যয় হলে সমাজ বন্ধ্যা হয়ে জঞ্জালে পরিণত হয়। তাইতো আমরা দেখি, সুস্থ সমাজে মানুষের ভাল কাজের স্বীকৃতি দেয়া হয় সময়মত।
আজ তেমনি ক্ষুদ্র হলেও এক মহতি স্বীকৃতির ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। ঘটনাটি কানাডার। সে ১৯১৩ সালের একটি ছোট্ট আবিষ্কারের ঘটনা। বৃটিশ-কলাম্বিয়া সরকারের ভূমি জরিপকারী রবার্ট হেনরি লি এর আবিষ্কার। ১৯১১ সালে হেনরি লি’কে বৃটিশ কলাম্বিয়ার ‘উত্তর থমসন’ ও ‘ক্লিয়ার ওয়াটার ভেলি’র ভূমি জরিপের ৪ বছর মেয়াদের ঠিকা দেয়া হয়। জরিপের এ কাজ করতে গিয়ে হেনরি লি ১৯১৩ সালের ২৪শে জুলাই সেখানকার ‘মার্টোল’ নামে একটি নদীর কোল ঘেঁষে উপস্থিত হন এমন এক স্থানে যেখান থেকে চাইলেই চোখ সরানো যায় না। প্রকৃতির অপরূপ লিলাভূমি সুউচ্চ পাহাড়ের গা ঘেষে জল এসে আছড়ে পড়ছে বিশালাকৃতির এক পাথর গর্তে। জলপ্রপাত। অভূতপূর্ব, অনন্যসুন্দর এক জলধারা গড়িয়ে পড়ছে নিচের দিকে অজোর ধারায়।
আবিষ্কারের আনন্দে আত্মহারা হয়ে হেনরি লি চিঠি লিখলেন তার চাকুরীদাতা বৃটিশ কলাম্বিয়ার মুখ্যমন্ত্রী সার রিচার্ড কেমব্রাইড-এর কাছে। জানালেন তার আবিষ্কারের কথা আর দাবীর অনুরোধ জানালেন জলপ্রপাতটির নাম যেনো হয় “মেকব্রাইড” জলপ্রপাত। তিনদিন পর মন্ত্রী মেকব্রাইড উত্তর লিখলেন। জানালেন জলপ্রপাতটির নাম হবে “জন সেবাস্তিয়ান হেল্মকেন”। মন্ত্রী মেকব্রাইড ব্যাখ্যা করে লিখলেন- হাডসন্স বে কোম্পানীর ডাক্তার এই হেল্মকেন সেই ব্যক্তি যিনি ১৮৭১ সালে ‘বৃটিশ কলাম্বিয়া’কে কেনাডিয়ান কনফেডারেশনে শরিক হতে সহায়তা করেছিলেন।
তাই বলছিলাম, দেশের জন্য, সমাজের জন্য তথা মানুষের জন্য কল্যাণকর কিছু করে গেলে মানুষ কেউ না কেউ তা স্মরণে নেবেই নেবে। মহৎ কাজ কখনও বৃথা যায় না। কোথায় ১৮৭১ আর কোথায় ১৯১৩ সাল। ৪২ বছরের ফারাক। একাধিক প্রজন্মের ব্যবধান। কিন্তু মানুষ ভুলেনি। মন্ত্রী অনায়াসেই তার নামে জলপ্রপাতের নাম রাখতে পারতেন। কিন্তু ওই যে সুশীল সমাজ। মানুষের মূল্যায়ন করতে ভুলে না।
অপূর্ব সুন্দর “হেল্মকেন” জলপ্রপাত আজো বয়ে চলেছে সেই নাম। তার জল পতনের ঝন ঝন শব্দে উচ্চারিত হয় একটি নাম “জন সেবাস্তিয়ান হেল্মকেন”। দুনিয়ার হাজার হাজার মানুষ প্রতি বছর আসেন প্রকৃতির দান এই জলপ্রপাতটি দেখতে। কিন্তু কঠিন সময়ের অবিচার “জন সেবাস্তিয়ান হেল্মকেন” কোনদিনই তার নামে দেয়া জলপ্রপাতটি দেখে যেতে পারেননি। তিনি ৯৫ বছর বয়সে ১৯২০ সালে দেহত্যাগ করেন। -হারুনূর রশীদ