-মং এ খেন মংমং
[শেষ পর্ব]
বিক্ষুব্ধ সাঁওতালরা বহু থানা, ইংরেজ সৈন্যদের ঘাটি, নীলকরদের কুঠি আক্রমণ ও ভস্মীভূত করে। সমগ্র বিহার, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সাঁওতালদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজ সরকার এ আকস্মিক বিদ্রোহের প্রচন্ডতায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে।
অবশেষে মার্শাল ল’ জারির মাধ্যমে ১৫ হাজার সৈন্য,অশ্বারোহী বাহিনী,কামান বাহিনী ও হস্তী বাহিনী দ্বারা বিদ্রোহ দমনের অভিযান চালান হয়। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়। প্রচন্ড বর্বরতায় উন্মত্ত হাতি ছেড়ে দেয়া হয় সাঁওতালি নারী ও শিশুদের মধ্যে। কামান ও বন্দুকের সামনে টিকতে না পেরে, বিদ্রোহীরা গভীর জঙ্গলে পলায়ন করতে বাধ্য হয়।
৩০ হাজার সাঁওতাল বিদ্রোহীকে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করে ইংরেজ মিলিত বাহিনী। ভাগলপুরে এক ভয়াবহ বন্দুক যুদ্ধে বিদ্রোহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নায়ক চাঁদ ও ভৈরব নিহত হয়। ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইংরেজ বাহিনী সিদুকে ধরে ফেলে, সঙ্গে সঙ্গেই হত্যা করে। কানু বীরভূম জেলায় একদল পুলিশ কর্তৃক ধৃত হলে তাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়। পরাধীন শৃঙ্খলিত ভারতবর্ষের সাঁওতাল বিদ্রোহের শ্রেষ্ঠ নায়ক সিদু, কানু এভাবেই স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে গেছে।
সাঁওতাল বিদ্রোহ নিপিড়ীত মুক্তিকামী মানুষের চিরদিনের প্রেরণার উৎস। এ সংগ্রামে পরাজয় ছিল, কিন্তু আপোষ ছিল না।বিদ্রোহীরা নির্ভয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে, কিন্তু আত্মসমর্পন করেনি। এ বিদ্রোহীদের আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কাহিনী প্রেরণা যুগিয়েছে ভারতবর্ষের পরবর্তী সকল স্বাধীকার আন্দোলনে।
ফাঁসির মঞ্চে কানুর দৃপ্ত উচ্চারণ ছিল “আমি আবার ফিরে আসব, সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলব”, বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা সূর্যসেনদের আত্মত্যাগে।
সাঁওতাল বিদ্রোহ দীর্ঘ ১৬০ বছর পর আবারও প্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছে, শোষণ মুক্তির সংগ্রাম কোনদিন ফুরায় না, শেষ হয়ে যায় না। মানুষ পৃথিবীতে যতদিন থাকবে শোষণ মুক্তির সংগ্রাম চলবে ততদিন।
উল্লেখ্য, ৬ নভেম্বর রোববার স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের লোকজন ও মিলের কর্তৃপক্ষ, বিজিবি ও পুলিশের সমন্বয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় ৬০০ সদস্যের অভিযানে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনজন স্থানীয় তিনজন ভূমির স্বত্বাধিকারী প্রান্তিক বীর সাঁওতাল শহীদ হন। বর্তমানে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন আরো তিনজন। একই হাসপাতালে চিকিত্সা চলছে তীরবিদ্ধ তিন পুলিশ সদস্যেরও। এছাড়া অন্তত দুজন করে বাঙালি ও সাঁওতাল নিখোঁজ রয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। পরিবারের আশঙ্কা, পুলিশ তাদের গুম করে ফেলেছে।
জানা গেছে, বাগদাফার্মে বাপ-দাদার জমিতে বসতি স্থাপনের সময় সাঁওতালদের ভরসা দিয়েছিলেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও স্থানীয় সংসদ সদস্য। বিশেষ করে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে হওয়ায় এ বিষয়ে অতি উত্সাহ দেখিয়েছিলেন সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাকিল আলম বুলবুল। ওই সময় শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও সাঁওতালদের বসতভিটা রক্ষা করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি। অথচ রোববার তারই উপস্থিতিতে হামলার ঘটনা ঘটল সাঁওতালদের ওপর। পুড়িয়ে দেয়া হলো তাদের বসতভিটা। উদ্বাস্তু হয়ে পড়া সাঁওতালরা বর্তমানে আবারো হামলার আশঙ্কায় ভীত হয়ে পড়েছেন।
চারদিনে সাকল্যে দু-একবেলা খেতে পেয়েছেন কেউ কেউ। আবার পেটে একেবারেই দানাপানি পড়েনি অনেকেরই। এ পর্যন্ত ৪০০ লোকের কাছে খাদ্যসহায়তা পৌঁছুলেও বাকিরা অভুক্ত। থাকার জায়গা নেই, মাথার ওপর ছাউনি নেই, খাওয়ার কিছু নেই, নেই দুই আনা সম্বল। এ অবস্থায় প্রাণ বাঁচাতে এলাকা ছেড়ে পাশের দেশ ভারতে চলে যাওয়ার সুযোগ চাচ্ছে রংপুর চিনিকলের বাগদাফার্ম এলাকা থেকে উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতাল পরিবারগুলো। যদিও চারদিক ঘিরে রাখা পুলিশ ও স্থানীয় ক্ষমতাশালীদের কারণে গ্রাম থেকেই কারো বের হওয়ার সুযোগ নেই।
স্বাধীন বাংলাদেশে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে বাগদাফার্মের স্বত্বাধিকারী প্রান্তিক-নি:স্ব আদিবাসী ও বাঙালিদের হত্যা, উচ্ছেদ, ঘরবাড়ি ভাংচুর, হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ভূমিদখল, নারী, মা ও শিশু নির্যাতনের দৃশ্যপটাবলী পাকবাহিনীকে হারমানিয়েছে।
কারা আক্রমণে উৎসাহ যুগিয়েছে, আর কারা আক্রমণ করেছে, ইতিহাসে সবই থাকবে। মধুপুর-টেকনাফ-নেত্রকোনা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া–তালতলী -কুয়াকাটা-আলুটিলা-গোবিন্দগঞ্জের ঘটনাগুলো ইতিহাস ক্ষমা করবে না।
অধিপতিশীল জ্ঞানকাঠামোয় সিদু কানুদের আত্মত্যাগের ইতিহাস সেভাবে উচ্চারিত হয় না, তাতে কি আসে যায়, জীবন যেখানে দ্রোহের প্রতিশব্দ, মৃত্যুই সেখানে শেষ কথা নয়।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষণের ১৮৫৫ থেকে ২০১৬ বাংলাদেশ পর্যন্ত সাঁওতাল বিদ্রোহের বীর শহীদদের লাল সালাম।
– মং এ খেন মংমং
সভাপতি, আদিবাসী কল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা