সাঙ্ঘা তেনজিং এর মমির উন্মুক্ত ছবি। ছবি সৌজন্য: দি ওয়াল |
সেই হিমাচল প্রদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামের নাম ‘গুয়ে’। উঁচু পাহাড়ী ভূমির উপর সে গ্রামের অবস্থান। বিভিন্ন সূত্র ঘাটাঘাটি করে যতটুকু জানা যায়, ‘গুয়ে’র সে অবস্থান স্বাভাবিক সমতল মাটি থেকে প্রায় ৬০০০ মিটার বা ১০,০০৭ফুট উপরে। ১৯৭৫ সালে এক ভয়াবহ ভুমিকম্পে নাকি কেঁপে উঠেছিল হিমাচল প্রদেশের প্রত্যন্ত ‘গুয়ে’ গ্রাম।
লাহুল স্পিতির ঐতিহাসিক টেবো মনাস্ট্রি থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে থাকা এই গ্রাম বছরে সাত আট মাস বরফে ঢাকা থাকে। সেই ভুমিকম্পে, গ্রামটির সব কিছু উলোটপালোট হয়ে গিয়েছিল। আর সেই উলোট-পালোটই খুলে দিয়েছিল মানব সভ্যতার নতুন এক চাঞ্চল্যকর ইতিহাস। কয়েক শতাব্দীর পাতাল ঘুম ছেড়ে উঠে এসেছিলেন ১৪০০ শতাব্দীর বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ‘সাঙ্ঘা তেনজিং’ মমি হয়ে। ভূ-কম্পনের সেই উলোট-পালটে মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে আসে ‘সাঙ্ঘা তেনজিং’ এর মমি হয়ে থাকা শরীরখানা। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় যে মমিটি এতটাই ভালো ভাবে সংরক্ষিত অবস্থায় ছিল, যে মমির চামড়া এবং মাথার চুল দুইই অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।
জানা যায়, ২০০৪ সালে আইটিবিপি সৈনিকরা নাকি উঁচু পাহাড়ে রাস্তা তৈরি করতে গিয়ে সন্ন্যাসী ‘সাঙ্ঘা তেনজিং’-এর মমিটি পান। ১৯৭৫সালের ওই ভূমিকম্পনের পর ১৯৮৩সালে টাবু মনাস্টেরী পূনর্নির্মাণ করা হয়েছিল।
সাঙ্ঘা তেনজিং এর মন্দির, গুয়ে গ্রাম, হিমাচল। ছবি সৌজন্য: ওয়াল |
‘মমি’ শব্দটি কানে বাজলেই মনের গভীরে ভেসে উঠে মিশরের পিরামিডের কথা। মনে জাগে মিশর বাদশাহদের শরীর মমিকরণের রোমাঞ্চকর কাহিনী। কিন্তু ভারতেও মমি তৈরির প্রথা ছিল তা ভাবনাতেই আসার মত নয়। অথচ মিশরীয় সভ্যতায় মমি বানাতে মৃতদেহের শরীরে বিশেষ ধরনের রাসায়নিকের প্রলেপ লাগানো হতো। কিন্তু ‘সাঙ্ঘা তেনজিং-এর মমিতে কোনও রাসায়নিকের প্রলেপ লাগানো হয়েনি। তবুও এত বছর ধরে এই মমি কিভাবে মাটির তলায় নিখুঁত ভাবে সংরক্ষিত ছিল সেটাও অবাক করে প্রত্নতত্ববিদদের। ‘সাঙ্ঘা তেনজিং-এর মমিটিকে ঘিরে রয়েছে একটি রহস্যও। এখনও নাকি বাড়ছে মমিটির চুল এবং নখ। বিজ্ঞানীরা অবশ্য এটিকে ভক্তির আতিশয্য বলেছেন তবে মানতে নারাজ ভক্তরা।
স্থানীয় সংরক্ষিত বৌদ্ধ ইতিহাস থেকে আরো জানা যায়, সন্ন্যাসী সাঙ্ঘা তেনজিং জীবিত অবস্থাতেই নিজেকে মমি করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই তাঁরা প্রস্তুতি নেন। খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ প্রায় ছেড়েই দেন। এক জায়গায় ধ্যানে মগ্ন থাকেন। ধীরে ধীরে উপবিষ্ট অবস্থাতেই মৃত্যু হয় তাঁদের। শরীরের জলশুন্যতা ও হিমশীতল আবহাওয়ায় প্রাকৃতিক ভাবেই মমিতে পরিণত হয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের শরীর।
এই নমুনায় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের নিজেদেরকে মমি বানানোর প্রথাকে বলা হয় শোকুশিনবৎসু (Sokushinbutsu)। জাপান ও চীনেও বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের এরকম মমির খোঁজ মিলেছে।
পেনসিল্ভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নবিদ্যা ও নরবিজ্ঞান যাদুঘরের বিশেষজ্ঞ ভিক্টর মেয়ার মমিটি পরীক্ষা করে জানিয়েছিলেন, মমিটি খুব কম করে হলেও ৫০০ বছরের পুরানো।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ধ্যানে মগ্ন থাকা অবস্থায় তেনজিং যখন বুদ্ধে বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন তখন তাঁর বয়েস ছিল মাত্র ৪৫ বছর। বর্তমানে গুয়ে গ্রামে ‘সাঙ্ঘা তেনজিং-এর মন্দির হয়েছে। সেই মন্দিরের ভেতরে রাখা কাচের বাক্সে সংরক্ষিত আছে ৫০০ বছর আগের মমিটি। গ্রামবাসীরা বৌদ্ধ সন্যাসীর মমিকে ঈশ্বর রূপে পুঁজো করেন। দেশ বিদেশের পর্যটকরা দেখতে আসেন সাঙ্ঘা তেনজিং-এর মমিকে। সূত্র: ইন্ডিয়া.কম, টাইমস অব ইন্ডিয়া ও দি ওয়াল।