যার ঋণ আমাদের অনেকেরই শোধ করার ক্ষমতা নাই। তিনি হচ্ছেন আমাদের হারুন ভাইয়ের সদ্য প্রয়াত সহধর্মিনী আমাদের সকলের প্রিয় ভাবী হেলেনা বেগম(হেলি )। তিনি গত ২৯শে মার্চ এই ইহজগতের মায়া ত্যাগ করে আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি বিগত কয়েক বছর যাবৎ দুরারোগ্য ক্যান্সারে ভুগছিলেন। আমি আমার ও আমার পরিবারের পক্ষ থেকে, আমাদের রাজনীতিক ও সামাজিক সহকর্মীদের পক্ষ থেকে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলমীনের কাছে তাঁকে জান্নাত উল ফেরদাউস দান করার জন্য আকুল আবেদন করছি।
নিজের গড়েতোলা “মুক্তকলি সাপ্লিমেন্টারী স্কুল। ছবির পেছনে ডানে দাঁড়িয়ে হেলেনা বেগম। |
তিনি শুধু একজন গৃহিনীই ছিলেননা, তিনি ছিলেন একজন সমাজ সচেতন মহিলা। সকল রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কার্যক্রমে তিনি অংশ গ্রহণ করতেন। আমি হারুন ভাই ও ভাবীকে অন্যের সহযোগিতা ছাড়া প্রতি শনিবার বাংলা স্কুল পরিচালনা করতে দেখেছি। নিজের সংসারের সকল কাজ কর্ম ফেলে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত স্কুল পরিচালনা করতেন। যাদের অভিবাবকরা বাচ্চাদেরকে নিতে আসতেন না, তাদেরকে ঘরে পৌছে দেওয়া ছিল তাঁদের কাজ। এই সমস্ত যাঁরা করেছেন, শুধু তাঁরাই বুঝতে পারবেন এটা কত কষ্টের কাজ। আমাদের পিছিয়ে থাকা অবহেলিত বাঙালী জন গুষ্টি যাতে নিজের মাতৃ ভাষা শিখতে পারে, তার জন্য তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন।
কেমডেনে যত প্রোগ্রাম হতো যেমন স্বাধীনতা দিবস, মাতৃভাষা দিবস কিংবা শিশুদের প্রোগ্রাম, সকল ক্ষেত্রেই তিনি হারুন ভাইয়ের সাথে ছায়ার মতো পাশে থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রতিটি অনুষ্ঠানকে সফল করার চেষ্টা করে গেছেন। একটা বিষয় আমি সব সময় লক্ষ্য করতাম, তিনি ক্যামডেন সহ আশেপাশের প্রায় সকল বাঙালীদেরকে চিনতেন।
মেয়েদের অংকনের এক ক্লাসে হেলেনা বেগম। ডানে দাঁড়িয়ে। | বানান সংশোধনী কাজে হেলেনা বেগম। |
সকালে এসে হল সাজানো, অনুষ্ঠানের সকল মানুষের সাথে হাসি মুখে আপ্যায়ণকরা থেকে খাবার পরিবেশন করা ছিল তাঁর কাজ। অনুষ্ঠান শেষে খাওয়া-দাওয়ার পর সারা হল যখন নোঙরা করে মানুষ চলে যেতো তখন আমাদের সাথে মিলে সব কিছু পরিষ্কার পরিছন্ন করতে আমাদেরকে সাহায্য করতেন। কখন ও মনক্ষুন্ন হতেন না। সব সময় কেমডেনের সমস্ত বাঙালী কমিউনিটির কাছে ছিলেন তিনি শ্রদ্ধার পাত্রী।
যেহেতু হারুন ভাই ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিক, সাংবাদিক এবং সমাজ কর্মী এবং তিনি মৌলভীবাজার শহরে বেড়ে উঠা মানুষ, সেহেতু বাংলাদেশ কিংবা ইউরোপ-আমেরিকা থেকে যারা লন্ডন আসতেন, যেমন সুইডেন থেকে বীর মুক্তিযুদ্ধা সুজাউল করিম, ফ্রাঁন্স থেকে বীর মুক্তিযুদ্ধা নুরুল হোসেন চৌধুরী, বীর মুক্তিযুদ্ধা দেওয়ান আব্দুল ওহাব চৌধুরী, কেনাডা থেকে ফয়সল আহমের চৌধুরী সহ অসংখ্য লোক যাদের নাম বললে তালিকা লম্বা হয়ে যাবে। তারা সকলেই হারুন ভাইয়ের ক্যামডেনের ফ্ল্যাটে আসতেন। আমাদেরকে ছাড়া(আমি, এডঃ ফারুক, আবুল কালাম) এই সমস্ত অতিথিকে হারুন ভাই কখনো একা আপ্পায়ন করাননি। অনেক মজাদার আইটেম দিয়ে ভাবী আমাদেরকে খুশি মনে আপ্পায়ন করিয়েছেন। কখনও ক্লান্ত বোধ করেননি। তাঁদের ফ্ল্যাটটা, আমাদের এসব বৈঠকি কাজের প্রয়োজনে বেশ ছোট কিন্তু তাঁদের মনটা হলো অনেক বড়। হারুনভাই ও ভাবীর বড় সে মনের কাছে আমরা এমনইভাবে হারিয়ে যেতাম যে গাদাগাদি করে বসে দাঁড়িয়ে আমাদের বৈঠককাজ শেষ করতাম। বৈঠকখানার পরিসর ছোট এবিষয় মনেই আসতো না।
কেমডেনে বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের একসভায় কয়ছর আহমদ। ডান থেকে চতুর্থ কালো স্যুট পরিহিত। | বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের এক রাজনৈতিক সভায় আরো মহিলাদের সাথে হেলেনা বেগম। বায়ে প্রথম। |
জন্মের পর সকলকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আমরা যখন এই পৃথিবীতে এসেছি আমরা সকলেই ফেরৎ যাবার ব্যবস্থাপত্র নিয়ে এসেছি। কিন্তু এর পরও আজ শুধু আমি একা নয়, আমার মত অনেকেই আমাদের প্রানপ্রিয় ভাবীর এই অকাল মৃত্যুকে মেনে নিতে পারছিনা। মনে বড় কষ্ট হয়। তিনি আমাদের কাছ থেকে চলে গেলেও আমাদের হৃদয়ের মাঝে বেঁচে থাকবেন অনেক দিন। তাঁর হাসি মাখা মায়াবী সুন্দর মুখ ও কর্মস্মৃতি সবসময় আমাদের হৃদয়ের মাঝে অম্লান হয়ে থাকবে। তিনি স্মরণীয় হয়ে ছবির মত ভেসে উঠবেন আমাদের সকল প্রার্থনায়।
পরম করুনাময় আল্লাহ তায়ালা তাঁর শোকসনতপ্ত পরিবারকে সবর করার ক্ষমতা দান করবেন, এ কামনাই প্রতিনিয়ত করছি। তাঁকে যেন কবরে শান্তির জিন্দেগী দান করেন এবং আখেরাতে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।
কয়ছর আহমেদ
1 April 2020 at 23:28:15 BST
koysor ahmed <ahmedhalal572@gmail.