আগুন জ্বলেছিল ১৫দিন। মাগুরছড়া গ্যাস বিস্ফোরণের ২৮ বছর আজ, এক মাসের মধ্যেই তদন্ত রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে জমা হয়েছিল। অক্সিডেন্টালের বিভিন্নধর্মী অযোগ্যতার কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটে |
আজ শনিবার(১৪ জুন), কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া বিস্ফোরণের ২৮ বছর পুরো হলো। এখনও বাংলাদেশ সেই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী মার্কিন প্রতিষ্ঠান অক্সিডেন্টাল থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারেনি। বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে নিস্ক্রিয় হলেও দেশের স্বার্থরক্ষার আন্দোলনকারীরা সরব রয়েছেন। ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্যরাতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া এলাকায় ফুলবাড়ী চা-বাগানের সম্মুখভাগে অবস্থিত ১নং গ্যাস অনুসন্ধান কূপে খননকালে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। আকস্মিক এ বিস্ফোরণের পর আগুনের লেলিহান শিখা ৬০০ ফুট উচ্চতায় উঠে যায়। ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য আজও ভাসে মৌলভীবাজারবাসীর মনের পর্দায়। ১৫ দিন আগুন জ্বলেছিলো। মারা যায় হাজার হাজার বন্যপ্রাণী ও পাখি১৯৯৫ সালে বৃহত্তর সিলেটের ১২, ১৩ ও ১৪ নম্বর ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয় মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টাল অব বাংলাদেশ লিমিটেডের। গ্যাস অনুসন্ধান শুরুর পর কমলগঞ্জবাসীর মনে দেখা দেয় আনন্দ। তেল-গ্যাসে সমৃদ্ধ হবে এলাকা- এই ভেবে এলাকার মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত হয়। ৩ হাজার ৭০০ মিটার কূপ খনন করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ৮৪০ মিটার খনন করার পরপরই ঘটে দুর্ঘটনা। আগুনে চা বাগান, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, বিদ্যুৎলাইন, সিলেট-আখাউড়া রেলপথ, শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ-শমসেরনগর-ব্রাহ্মণবাজার-কুলাউড়া সড়কপথ, গ্যাস পাইপলাইন, গ্যাসকুপ, রিজার্ভ গ্যাস, পরিবেশ, পানি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মারা যায় হাজার হাজার বন্যপ্রাণী ও পাখি। টানা ১৫ দিন আগুন জ্বলার পর যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনের ইন্টারন্যাশনাল অয়েল কোম্পানির বিশেষজ্ঞ রিচার্ড চাইল্ড রি-সহ চার সদস্যের একটি দল আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। তবে পুরো কুপের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগে প্রায় ছয় মাস। মাগুরছড়ায় সংঘটিত ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনার স্মৃতি আজও ভুলতে পারেনি কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল তথা মৌলভীবাজার জেলার মানুষ। সেই বিপুল ক্ষতির জন্য এলাকাবাসী কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। সে সময় ১৪ হাজার কোটি টাকার গ্যাস পুড়েছিলতেল-গ্যাস বিশেষজ্ঞদের মতে, মাগুরছড়া গ্যাসফিল্ডে ভূগর্ভস্থ উত্তোলনযোগ্য ২৪৫.৮৬ বিসিএফ গ্যাস পুড়ে যায়, যার দাম প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য ক্ষতি আরও ১১ হাজার কোটি টাকা। দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট একাধিক গবেষণা থেকে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। অগ্নিকাণ্ডে মাগুরছড়া ও আশপাশের ৮৭ দশমিক ৫০ একর এলাকা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২৯টি চা-বাগানের ৪৬ কোটি ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৮৩০ টাকার ক্ষতি হয়।দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের কারণে ২৯টি চা-বাগানের ৪৬ কোটি ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৮৩০ টাকার ক্ষতি হয়। তা ছাড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৬৯.৫ হেক্টর এলাকার ২৫ হাজার ৬৫০টি পূর্ণবয়স্ক গাছ আগুনে পুড়ে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি হয় প্রায় ৩৩ কোটি ৬১ লাখ টাকার। সরকারের তদন্তে ক্ষতি বাবদ ধরা হয় ৫০৭ কোটি ১২ লাখ টাকা। এ ছাড়া বনাঞ্চলের সম্ভাব্য ক্ষতি হয়েছে ৪০ হেক্টর ভূমি এবং ১৫ হাজার ৪৫০টি বৃক্ষ। ক্ষতি থেকে পুনরুদ্ধার পেতে ১০ বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৪৮৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ বনাঞ্চলের মোট ক্ষতি ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৮৫৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা। বিস্ফোরণের ফলে ২ হাজার ফুট রেলওয়ে ট্র্যাক ধ্বংস হয়েছে। এতে রাজস্ব ব্যতীত ক্ষতি হয়েছে ৮১ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯৫ টাকা। সড়ক পথের ক্ষতি ২১ কোটি টাকা। গ্যাস পাইপলাইনের ক্ষতি ১৩ লাখ টাকা। বিদ্যুৎ লাইনের ক্ষতি ১ কোটি ৩৫ লাখ ৯ হাজার ১৮৬ টাকা। মাগুরছড়া খাসিয়া পানপুঞ্জির অধিবাসীদের পানের বরজসমূহে প্রতিদিন ৪৭ হাজার ৭৫০ টাকা হারে মোট ক্ষতি ১২ লাখ টাকা। কমলগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনের ১২৫০ হেক্টর এলাকাকে ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী আইন অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে ঘোষণা করা হয় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। মাগুরছড়া গ্যাসকূপের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এ বনের বিপন্ন বন্যপ্রাণীসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যায়। গ্যাসকূপ খনন কাজে সাধারণত ‘ডিনামাইট’ জাতীয় বিস্ফোরক ব্যবহার করার নিয়ম থাকলেও অক্সিডেন্টাল মাগুরছড়ার গ্যাস কূপ খনন কাজে বিস্ফোরক হিসেবে প্রাণঘাতী ও পরিবেশবিনাশী তেজস্ক্রিয়যুক্ত ‘রেডিও অ্যাকটিভ সোর্স’ ব্যবহার করেছিল বলে অভিযোগ করেছে জাতীয় তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি। অক্সিডেন্টালের খননকাজে আনাড়িপনা, অনভিজ্ঞতা, দায়িত্বে অবহেলা, উদাসীনতা, অযোগ্যতার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে ওই কমিটির অভিমত। মাগুরছড়া অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে আন্দোলন এখনও চলমান। প্রতি বছর ১৪ জুন এ এলাকার সাধারণ মানুষ মানববন্ধনসহ নানা কর্মসুচি পালন করে চলেছেন। ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন বিস্ফোরণের পর ছয় মাসের অধিককাল ধরে জ্বলতে থাকা কুপের উৎস মুখ সিল করার কাজ সম্পন্ন হয় ১৯৯৮ সালে ৯ জানুয়ারি। তার আগেই ১৯৯৭ সালের ২০ ডিসেম্বর অক্সিডেন্টাল মাগুরছড়া থেকে বিদায় নেয়। এ অবস্থায় এলাকায় জনগণের মধ্যে দেখা দেয় তীব্র প্রতিক্রিয়া। ১৯৯৮ সালের ১০ জানুয়ারি রাস্তায় বড় বড় গাছ ফেলে ব্যারিকেড তৈরি ও প্রতিবাদ করে হাজার হাজার মানুষ। সাধারণ মানুষ শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ-মৌলভীবাজারসহ সমগ্র সিলেট বিভাগ ও দেশের বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, পদযাত্রা করে। মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির মন্ত্রী জিডিসন প্রধান সুচিয়াং বলেন, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক বনের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা কেউ বুঝতে পারেনি। আমরা যারা এ বনে বসবাস করছি তারা বুঝতে পারছি। এ বিষয়ে মাগুরছড়া তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা সৈয়দ আমিরুজ্জামান বলেন, ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মাগুরছড়া গ্যাসকূপে অগ্নিকাণ্ডের পর যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সে কমিটি এক মাসের মধ্যেই তদন্ত রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। ওই রিপোর্ট বীমা কোম্পানিতে জমা দিয়ে অক্সিডেন্টাল তাদের বীমাকৃত যন্ত্রাংশ, রিগ ইত্যাদির ক্ষতিপূরণ আদায় করে নেয়। কিন্তু কোম্পানির কাছ থেকে সরকার বা এলাকাবাসী এখনও কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। সরকার আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হলে অক্সিডেন্টাল থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা সম্ভব বলে মনে করেন সৈয়দ আমিরুজ্জামান। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বনের ক্ষতি নিরূপণ করা হলেও এ পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি কোনো সময়ে পুষিয়ে ওঠার নয়। পরিবেশ বিপর্যয়ের ব্যাপারে আগের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। এদিকে মাগুরছড়া ট্র্যাজেডির ২৮তম বার্ষিকী উপলক্ষে আজ ১৪ জুন শনিবার পাহাড় রক্ষা উন্নয়ন সোসাইটি, জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটি, কমলগঞ্জ উন্নয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন এর উদ্যোগে কমলগঞ্জে মাগুরছড়া গ্যাস বিষ্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা জনসম্মুখে প্রকাশ, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও কমলগঞ্জের ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগের দাবীতে এক মানববন্ধন কর্মসুচী পালিত হচ্ছে। |