নিপু কোরেশী
একটি কুঁড়ি দু’টি পাতা
🌱সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এক অপূর্ব পরিবেশ বাংলাদেশের প্রতিটি চা বাগানে। আমার মরহুম পিতা রাজনগর পোর্টিয়াস হাই স্কুল থেকে লেখাপড়া শেষ করে সরাসরি যোগ দেন চা বাগানের কর্ম জীবনে। এই পেশা পছন্দের পিছনে আমার বাবার আপন মামার ভূমিকা ছিলো উল্লেখযোগ্য। মরহুম জনাব আব্দুল মান্নান চৌধুরী (তৈয়ব) সে সময়ে চা বাগানের একজন সুপ্রতিষ্টত ম্যানেজার এবং তিনিই বাবাকে নিয়ে আসেন সেই পেশায়।
🌱আমরা তিন ভাই দু’বোন নিয়ে ছিলো মা-বাবার সুখের সংসার। বাগানে বেড়ে ওটা এক শিশু আজকের এই ডিজিটাল যুগে পড়ন্ত বয়সে এসে কোন কিছুতেই মিল খুঁজে পাইনা। সবুজ শ্যামল পরিবেষ্টিত মনোমুগ্ধকর পরিবেশে বড় হওয়া আমাদের জীবন আর আজকের এই যান্ত্রিকতা এ যেন একে অন্যের বিপরীতে অবস্থান।
🌱হিন্দু অধ্যুষিত বাগান গুলোতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিলো অকল্পনীয়। স্কুল শেষে বিকেলবেলা ছুটে যেতাম আমাদের বন্ধুদের বাসায়। ওদের অধিকাংশই ছিলো হিন্দু ধর্মের। লুকোচুরি খেলা ছিলো আমাদের প্রিয় খেলা। বন্ধুদের মা-বাবাকে আমরা মাসিমা -কাকাবাবু বলে ডাকতাম। উনারাও আমাদেরকে অতি স্নেহ করতেন।
|
🌱চাকুরী জীবনে বাবাকে বদলি হয়ে বিভিন্ন চা বাগানে যেতে হয়েছে। এখনো মনেপড়ে বদলির দিন বাসার সামনে দু-তিনটি ট্রাকটর এসে দাড়াতো। যা আমাদের আসবাবপত্র বহন করে বাবার নূতন কর্মস্থলে পৌঁছে দিতো।
🌱সেই সময়ে যতোটুকু মনেপড়ছে প্রতিটি বাগানে স্থানীয়ভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিলো। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো আমরা পিঠাপিঠি দুই ভাই এবং এক বোন যখন উচ্চ বিদ্যালয়ে উঠলাম তখন। কারন বাগানের নিকটবর্তী কোন উচ্চ বিদ্যালয় ছিলো না। আমাদেরকে পায়ে হেটে অন্তত তিন মাইল দূরে অবস্থিত উচ্চ বিদ্যালয়ে আসা যাওয়া করতে হতো। তবে দলবেঁধে বাগানের সবার একসাথে যাওয়া হতো বলে সেই হাঁটাতেও ছিলো এক অন্য রকমের প্রান।
🌱সেই সময়ে বাগান গুলোতে বিদ্যুৎ ছিলো না। সন্ধা বেলা হারিকেন জ্বালিয়ে আলো নিতে হতো এবং পড়ার টেবিলে এই হারিকেনই আলো যোগাতো। বাগানের জীবনে যে বিষয়টির প্রতি আমি বেশী কৃতজ্ঞ বা আকৃষ্ট তা হলো বাগান কতৃপক্ষ প্রতিটি বাসায় বিভিন্ন ধরনের কাজের জন্য নির্দিষ্ট পেশার কাজের লোক নিয়োগ করতেন। যেমন রান্নাঘরে আম্মার কাজের সুবিধার জন্য বাবুর্চি বা বোয়া। সবজি ও ফুলের বাগানের জন্য মালী। যিনি বাসায় পানি যোগান দেওয়ার দায়িত্ব সহ গরু,ছাগল, হাঁস মোরগ দেখাশোনা করতেন। রাত্রীবেলা পাড়ার নিরাপত্তার জন্য নৈশ প্রহরী নিয়োজিত থাকতেন। জানি না আজো এই সকল সেবা প্রদান করা হয় কি না? তবে আজকের এই কৃত্রিম সমাজব্যবস্থায় তা যেন অকল্পনীয় এক ভূবণ। তাইতো এই সোনালী অতীত আজো খুব বেশী তাড়া করে।
🌱বাবা ফ্যাক্টরি বাবু হিসেবে বিভিন্ন সময়ে যেসকল চা বাগানগুলোতে কাজ করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দেওড়াচড়া, লংলা, সাকেরা, মণিপুর ও সর্বশেষে উত্তরবাগ চা বাগান। ৭৭/৭৮ সালের দিকে ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সমাজে যখন মধ্যপ্রাচ্যে যাবার হিড়িক পড়লো বাবাও তখন বাগানের চাকুরী ছেড়ে সেই মিছিলে যোগ দিলেন। আমরা পুরো পরিবার চলে গেলাম আমাদের দাদার বাড়ী রাজনগর উপজেলার মুশরিয়া গ্রামে। তখন আমি ৭ম শ্রেণীতি ভর্তি হই খলাগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ে। তারপর ১৯৮০ সালে এসে ভর্তি হই মৌলভীবাজার জেলার সুনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্টান “মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে”।
🌱তখন থেকেই শুরু হয় গ্রাম ছেড়ে শহরে বসবাস। যদিও নানার বাসা মৌলভীবাজার শহরে অবস্থিত হওয়ার সুবাদে মৌলভীবাজারে আসা-যাওয়া ছিলো নিত্যনৈমিত্তিক একটি বিষয়। তারপর থেকে জীবনের পট পরিবর্তন হয়েছে অনেক। গ্রাম ছেড়ে শহরে, শহর ছেড়ে রাজধানী এবং সর্বশেষে রাজধানী তথা মাতৃভূমি ছেড়ে সেই সুদূর বিলেতে। এতোকিছুর পরও মনটা আজো খুঁজে সবুজে ঘেরা সেই চা বাগানগুলোকে। যেখানে জীবন ছিলো জীবিত, মানুষের মুখে ছিলো হাসি, অল্পতেই তৃপ্তি ছিলো অধিক, শিক্ষা মানুষকে শিখাতো মানতবা।
🌱মনেপড়ে অজপাড়াগাঁয়ের সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোন এক শিক্ষক প্রতিদিন বলতেন:
“Old is gold”
এই কথাগুলোর মর্মার্থ আজ যেন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
“ভালো থেকো অতীত
ভালো হোক বর্তমান।
ভালো হোক ভবিষ্যৎ,
মানবতা বাসা বাঁধুক
মানুষের হৃদয়ে”
|