হারুনূর রশীদ।।
কেনো আমরা এমন? আমাদের শিক্ষিতজন দীর্ঘ সময়ের ব্যবসায়ী অধ্যবসায়ে নয়, উল্টো পথে ব্যাঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করে কোটিপতি, শিল্পপতি হয়। আমাদের শিক্ষিত সমাজ, মোল্লা-মাওলানা পর্যন্ত আমরা সকলেই, ধর্ষণ যে চরম লজ্জ্বাজনকই শুধু নয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ সারা দুনিয়াব্যাপী, তা জেনেও নির্দ্বিধায় এ অপরাধ করে যাই। ধর্ষক শব্দটি যে ‘শরম বা লজ্জ্বা’ নামক মানবিক বোধের সাথে অতঃপ্রোতভাবে জড়িত তা আমাদের ভাবনায় কাজই করেনা। অথচ শুধু ভাব দেখাইনা আমরা বড় গলায় বলি হাজার বছরের সভ্যতা নিয়ে আমরা বর্তমানে আছি। অবশ্যই এ কথাগুলো সকলের জন্য নয়। কিছু কিছু মানুষ দুনিয়ার সকল সমাজেই আছে এসকল অমানবিক পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে নীতিগতভাবে সোচ্চার।
আমাদের ওসি, এসপি, ডিসি থেকে সচিব পর্যন্ত যারাই আছেন সকলেইতো কোন না কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদধারী। তাদের অনেকেই আবার বিদেশের বিভিন্ন সনদ নিয়ে দায়ীত্ব নির্বাহ করে যাচ্ছেন। অবসরপ্রাপ্ত এমন অনেক সনদধারী মানুষ আমাদের রাজনীতিতেও আছেন। এরপরও আমরা এমন কেনো? এমনতরো উচ্চ শিক্ষিত হয়ে কিসের টানে আমরা আমাদের সামাজিক দায়ীত্ব ভুলে যাই। আমাদের সভ্যতার গায়ে কলঙ্ক লাগিয়ে দিতে এতোটুকুও ভাবি না! কি আমাদের সেই না পাওয়ার যন্ত্রনা? শুধুই কি আখের গোছানো? আমাদের কাছে এ এক অবোধ্য প্রশ্ন!
পাকিস্তান আমলে আমরা দেখতাম কিছু লোক প্রশাসনের সাথে খুব দহরম-মহরম করে চলতো এবং নিজের আখের গোছাতো। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে আমরা সকলেই এদের দালাল বলতাম। এখন দেখি সকলেই সেই দালালির জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছে এবং করেও যাচ্ছে নির্দ্বিধায়, নিশ্চিন্তে। আমার এই বাখানের মূল কারণ সোনাগাজীর কন্যা নুসরাত হ্ত্যা নিয়ে। আলিম পড়ুয়া ছাত্রী ছিলেন নুসরাত জাহান রাফি। মা-বাবা কত আশায় বুক বেঁধে তাকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছিলেন। পাঠিয়েছিলেন মাদ্রাসায়। তারা কি জানতেন পবিত্র সে মাদ্রাসা শিক্ষাঙ্গনেও উৎপেতে বসে আছে শিক্ষক ভেশে এক নরশয়তান, যে জীবন কেড়ে নেবে তাদের নারীছেঁড়া ধন নুসরাতের।
নুসরাতের পরিবার মাদ্রাসার শিক্ষকনামী লম্পটের চরম অশ্লীল আচরণের পর স্থানীয় প্রশাসনে নালিশ দিয়েছিলেন। নালিশ দিয়েছিলেন পুলিশেও। একজন ছাত্রীর অসহায়ত্বের সময় তার সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসেনি। দেশের সমাজ রাজনীতি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রসেবা প্রশাসন ও পুলিশ কেউ তাকে সাহায্য করেনি। ফলে তাকে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মরতে হয়েছে। এ মৃত্যুর জন্য তা’হলে আসল দায়ী কে বা কারা?
সংবাদ ও গণমাধ্যম থেকে যা জানা যায়, তা অবাক করে দেয়ার মত। লেখক রাজিক হাসান তার ফেইচবুকে যে বর্ননা দিয়েছেন তা এতই হৃদয়বিদারক, লজ্জ্বার এবং যন্ত্রনাদায়ক যে, কোন সুস্থ্য মানুষকে উন্মাদ করে তুলতে যথেষ্ট। রাজিক হাসানের ওই লিখা থেকে আমাদের হিংস্র বন্য পৈশাচিক মনেরই চিত্র পাওয়া যায়। জানা যায়, ঘটনার সূচনাতেই জেলাপ্রশাসককে জানানো হয়েছিল, স্মারকলিপিও দেয়া হয়েছিল নুসরাতের জীবনের উপর হুমকির কথা জানিয়ে কিন্ত প্রশাসন এগিয়ে আসেনি। এমনও জানা গেছে যে নুসরাতকে হত্যার খরচের জন্য মাদ্রাসারই এক শিক্ষক হাফেজ আবদুল কাদের প্রাথমিকভাবে ৫ হাজার টাকা দেয়। মকছুদ নামের এক পৌর কাউন্সিলর দিয়েছিল আরও ১০ হাজার টাকা। নুসরাতেরই সহাপাঠীদের ২জনসহ ৫জনের একটি দল তার গায়ে আগুন দিয়েছিল। কি লোমহর্ষক কাহিনী! এদেরকে মানুষ বলবো না অন্যকিছু!
গণমাধ্যম থেকে আরো জানা যায় যে নুসরাতের পৈশাচিক হত্যা ঘটনায় সরাসরি জড়িত একজনের নাম হলো কামরুন নাহার মনি। পশু চিন্তার এই মনি নুসরাতের গায়ে কেরাসিন ঢেলে আগুন ধরিয়েছিল। এই মনি, হত্যাকারী অপর তিন সহযোগী পুরুষের জন্য তিনটি বোরকা ও হাতমোজা সংগ্রহ করেছিল ঘটনার আগে এবং এই হত্যা মামলার প্রধান আসামী শামীমের হাতে তুলে দিয়েছিল মনি নামের এই পিশাচিনী। আর এমন পশুবৃত্তিক কাজের জন্য সে দু’হাজার টাকাও নেয়। টাকা দিয়েছিল আরেক দুর্বৃত্ত উম্মে সুলতানা পপি। পপিকে এই টাকা দিয়েছিল শামীম। এমন সাজিয়ে গুজিয়ে আগুনে পুড়ে মানুষ হত্যা কোন মানুষ করতে পারে(?) এটি বিশ্বাসের বাইরে। কিন্তু তাই ঘটেছে নুসরাতের বেলায়।
পৈশাচিক এই হত্যা পরিকল্পনার এখানেই শেষ নয়। নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ার আগে অপরাধীরা প্রয়োজনীয় সব উপকরণ ঘটনাস্থল অর্থাৎ তিনতলার ছাদে রেখে আসে। ঘটনার সময় নুরু উদ্দিন ও হাফেজ আবদুল কাদেরসহ আরও পাঁচজন গেটে পাহারায় ছিল। নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর শামীম দৌড়ে নিচে নেমে মাদ্রাসার উত্তর দিকের প্রাচীর টপকে বের হয়ে যায়। সবচেয়ে লোমহর্ষক যা তা হলো, আগুন লাগানোর পর থানা আওয়ামীলীগ সভাপতি রুহুল আমিনকে মোবাইল ফোনে জানানো হয় নুসরাতকে পুড়ানো শেষ হয়েছে। তখন তিনি শান্ত কণ্ঠে বলেন, “আমি জানি, তোমরা চলে যাও”। তিনি অভয় দেন থানা পুলিশ প্রশাসন ম্যানেজ করার দায়িত্ব তার।
মানুষ নিজের লোভ-লালসার জ্ন্য এমন পিশাচ হতে পারে, মন বিশ্বাস করতে চায় না। কাহিনীর শেষ অংকে ওসি মোয়াজ্জেম বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াতে ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা শুরু করে। সঙ্গে ছিল সেই এলাকার ৭ সাংবাদিক। তারাই মূলতঃ ওসির হয়ে কাজ করে। মামলার এজাহারে পুলিশ ভুল তথ্য দিয়ে ঘটনা ভিন্ন দিকে নেবার চেষ্টা করে ও নানা তথ্য গোপন করে। সেই ওসিকে রক্ষার করার জন্য এসপি জাহাঙ্গীর আলম পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি পাঠায়। চিঠিতে বলা হয়, ঘটনার দিন নুসরাত মাদ্রাসায় যায়। এরপর তাঁর বসার স্থানে ফাইলপত্র রেখে সাইক্লোন শেল্টারের ছাদের ওপরে বাথরুমের কাছে যান। কিছুক্ষণ পর গায়ে আগুন লাগা অবস্থায় সিঁড়ি দিয়ে চিৎকার করতে করতে নেমে আসে। তখন কেন্দ্রে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য ও মাদ্রাসার কর্মচারীরা আগুন নিভিয়ে ফেলে।
ঘটনাটি এমনভাবে বলা হয়েছে যাতে মনে হচ্ছে, নুসরাত নিজের ইচ্ছাতেই ভবনের ওপরে যায়। অথচ তাঁকে পরিকল্পনা করে ডেকে নেওয়া হয়। এরপর হাত–পা বেঁধে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার কোনো কথাই উল্লেখ করা হয়নি।
লেখক রাজিক হাসান তার ফেইচবুকে এ হত্যার বিচার চেয়ে যা লিখেছেন তা সুস্থ বিবেককে তাড়না দেয়। তিনি লিখেছেন-
“বিচার চাই তাদের যারা সাধারন একটা মেয়েকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে।
বিচার চাই তাদের যারা সেই হত্যাকে তামাদি করে দেবার জন্য প্রশাসন-পুলিশ-জনপ্রতিনিধি-রাজনৈতিক নেতা-অধ্যক্ষ-শিক্ষকদের সুনিপুনভাবে আঁতাত করে গেছে।”
ঘটনার পৈশাচিকতায় মনের গভীরে জন্মনেয়া তীব্র ক্ষোভ ও দুঃখ থেকে রাজিক আরো লিখেছেন- “অভিশাপ দেই তাদের যারা জনগণকে পায়ের তলায় পিষে মারে আর তাদের সাথে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করে; অভিশাপ তাদের প্রতি, যারা জাতি আর ধর্মের আবেগ নিয়ে ব্যবসা করে, মানুষকে বিভ্রান্ত করে; যারা দেশের সম্পদ লুটতরাজ আর পাচার করে; গরিবের শ্রম শুষে, তাদের পুড়িয়ে মেরে আরও ধনী হয়।…”
সবকিছুর পর একটি আশার কথা হলো নুসরাত হত্যা ঘটনায় এ পর্যন্ত জড়িত ১৮জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিচারের স্বার্থে এটি একটি শুভ দিক। আমরা আশা করবো নুসরাতের পরিবার সুবিচার পাবে। শিক্ষক, রাজনীতিক, কমিশনাররূপী নরপিশাচদের কঠোর শাস্তি হচ্ছে তা আমরা দেখতে পাবো। আমরা ধর্মান্ধ ধর্ষক সমাজ নই, এ সত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবো।