উনসত্তরে নবম শ্রেনী, সত্তরে দশম শ্রেনী আর একাত্তরের মার্চে মেট্রিক পরীক্ষাত্রী ছিলাম আমরা। আন্দোলন সংগ্রাম মিছিল মিটিং আর জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত ছিল সে সময়ের গ্রাম ও শহরগুলো। আমরা এমন এক সৌভাগ্যবান সাথে সাথে দুর্ভাগা প্রজন্ম, যারা দেখেছি একটি স্বাধীন দেশের জন্ম অপর দিকে হাজার হাজার শহিদ ও লক্ষ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত হানী এবং লাশের স্তুপ।
আমাদের সিনিয়রদের অভিজ্ঞতা আরও অনেক বেশী অবশ্য জুনিয়রদের অনেকের ঐ অভিজ্ঞতা আছে। আমাদের সিনিয়ররা মুক্তি যুদ্ধে গিয়েছিলেন কিন্তু বয়স, শারিরীক যোগ্যতা ও পরিবারিক কারনে আমরা মুক্তি যুদ্ধে যেতে পারি নাই, তার পরও আমাদের সমসাময়িক হাতে গুনা ক’জন মুক্তি যুদ্ধে গিয়েছিল। কেমন করে সদ্য স্বাধীন দেশের সাংকৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরির্বতন ঘটতে পারে তার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী আমরা। সমগ্র সিলেট প্রবাসী অধ্যুষিত হওয়ার পরও বিধ্বস্ত অবকাঠামো, অর্থনৈতিক অস্থিরতা, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক উচ্ছাবিলাস সামাজিক জীবনে মারাত্বক পরিবর্তন ঘটায়। ভঙ্গুর অবকাঠামো, কর্মসংস্হান, নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় মনোনিবেশ করায় অনাগ্রহ দেখা দেয়। স্বাধীনতার পর স্কুল কলেজগুলো চালু হতে বেশ সময় লেগে যায়, তারপর শিক্ষকসহ অন্যান্য রিসোর্সের অভাব মেট্রিক ও ইন্টারমিডেট পরীক্ষা সমুহ সংক্ষিপ্ত সিলেবাস ও ৩০০ মার্কসের এবং অন্যান্য ক্লাসের অটো প্রমোশনের সিদ্ধান্তে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়।
ষাটের দশকে আমরা গ্রামে ছাত্রছাত্রীরা সন্ধার পর বাড়ীর উঠোনে চাটি বিছিয়ে মাঝখানে হারিকেন(লেন্টন) রেখে পড়তে বসতাম। সকল বাড়ীতে হারিকেন ছিল না লেম(কুপি বাতি) ছিল সম্বল। পরবর্তীতে হারিকেনের উন্নত ভার্সন টেবিল লেম্প আসল পড়া লেখার জন্য। গ্রামের এক এক বাড়ীতে ৪/৬/৮/১০ ঘর ছিল। লম্বা উঠানে ২/৩ ভাগে, বয়স অনুযায়ী দল বেঁধে লেখা পড়া করতে বসতাম আমরা। আমাদের পড়াতেন মাফিক চাচা(সৈয়দ বজলুল করিম), আরেক দলকে পরাতেন উনার বড় ভাই শফিক চাচা(সৈয়দ ফজলুল করিম)। আমি, আখলাক চাচা, সাচ্ছু, জবায়ের, হেনু ফুফু আমরা এক বয়সীরা এক গ্রুপ, আমাদের ছোটরা আলাদা গ্রুপ। আমরা প্রতিদিন সকালে মক্তবে পড়তে যেতাম, গ্রামের জামে মসজিদের কাছে মাঝর(মাঝের) বাড়ীর সামনেই মক্তব। মক্তবে কোনাপাড়া, শেখের বাড়ী, তরফদার বাড়ী সহ সৈয়দ গোষ্টির ছোট বড় সবাই পড়তে আসত। রেহানা, আছমা, হেনু, রুনু, নাজমা, সাজনা, রওশনারা, পেস্তা ফুফু(সবাই আমার ফুফু), আছাব, আহাদ, ফয়ছল, লিয়াকত, আখলাক, সাচ্ছু, এস্কান্দর, শাহজান, মাঝেমধ্যে ফারুক ও মুন্না চাচা(সবাই আমার চাচা), মোসাদ্দিক, মইনু/মজনু, মোসলেহ এবং আমি নিজেও পড়তে যেতাম। গ্রামে মুটি তুলে হুজুরের সম্মানী প্রদান করো হতো(মুটি অর্থ এক মুটি চাউল, জন প্রতি সাপ্তাহে ৬মুটি চাউল হুজুরের জন্য সংগ্রহ করা হতো) আজকের দিনে অনেকের কাছে ব্যাপারটি আশ্চর্যের মনে হতে পারে।
আমাদের গ্রামে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং কলেজ পড়ুয়া শিক্ষাত্রী ২৫/৩০ জনের অধিক ছিল। স্থানীয় শিক্ষাত্রী বাদেও আমাদের গ্রামে জায়গীর (দুর দুরান্তের গৃহ শিক্ষক হিসাবে) শিক্ষাত্রী ছিলেন আরও আট দশ জন। হেমন্ত, শীত ও বসন্তে গ্রাম থেকে স্কুলে যাওয়ার আনন্দ অনুভুতির আজও হৃদয়ে গুজ্ঞন করে। একত্রে দল বেঁধে ভাই বন্ধু, চাচা ফুফু, পাশের গ্রামের শিক্ষাত্রী স্কুলে যাবার দৃশ্যটি আজও সুখ সৃতি হয়ে আছে, মনে পরে সেই হারানো দিনের কথা। গ্রাম থেকে স্কুলে যাবার দৃশ্যটি সুখকর হলেও পায়ে হেঁটে যেতা হতো বেশ কষ্ট হতো বিশেষ করে আমরা যারা ছোট ছিলাম।
বর্ষার পুর্ব পর্যন্ত আমরা সবাই বালিকান্দি খেঁয়াঘাট দিয়ে নদী পাড় হয়ে মৌলভীবাজার সিলেট রোড ধরে শাহবন্দর, ঘরোয়া, শ্রীরামপুর, হিলালপুর, বড়হাট ও শেখেরগাও এর শিক্ষাত্রীদের সাথে এক হয়ে মিলে মিশে স্কুলে যেতাম। বর্ষাকালে আমরা নদী পাড় হওয়ার সাহস পেতাম না, তাছাড়া নদী পাড়া পাড়ে অনেক সময় লাগত কারন নৌকা উজনে বহুদুর গিয়ে অপর পাড়ের দিকে রওয়ানা দিয়ে ঘাটের অনেক ভাটিতে তীরে ভীড়ত। আবার ঘাটে পৌছাতে দীর্ঘ সময় নিত। তখন কাদা মাটির গাংগ আইল (নদীপাড়ের রাস্তা) দিয়ে পায়ে হেঁটে বলিয়ার ভাগ ও শাবিয়ার শিক্ষাত্রীদের সাথে বাজারঘাট দিয়ে নদী পাড় হতে চাইতাম, তাতে ব্যার্থ হয়ে গুজারাই পেরিয়ে চাঁদনীঘাটের পুল (ব্রীজ) পার হয়ে চৌমোহনা দিয়ে স্কুলে যেতে হতো। বাইসাইকেল ওয়ালাদেরও ছিল একই দশা।
শহরে পুরাতন আধা-পাকা(সুরকির ছাদ) সরকারী উচ্ছ বিদ্যালয়র অফিস ভবন, মৌলভবীজার এস ডি ও অফিস/কোর্ট ভবন, এস ডি ও’র বাংলো, কলেজের বিজ্ঞান ভবন, চৌমোহনায় হাবিব ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইউনাইটেড ব্যাংক, কল্পনা সিনেমা হল, সিএন্ডবি অফিস, পশ্চিম বাজার জামে মসজিদ(আধা পাকা), দেওয়ানী মসজিদ এ তার আশপাশের কয়েকটি বাড়ী সহ আরো বেশ কিছু স্থাপনা। ষাটদশকের শেষদিকে বেসরকারি ভাবে বেশ কিছু পাকা বাড়ী ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্মান হতে দেখা যায়। যেমন আলফত হাউজ (সরকারী উচ্ছ বিদ্যালয়ের বিপরিতে), কুসুমবাগ সিনেমা, রেজিয়া হোটেল সহ আরও বেশ কিছু। শহরের আশপাশের গ্রাম গুলোর লোকজন অর্থাৎ আমাদের অভিবাবকরা ছিলেন শিক্ষক, ব্যবসায়ী, প্রবাসী ও অন্যান্য কর্মজীবী। বেশীর ভাগই গ্রামের নিজ বাড়ীতে বসবাস করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন। শহর আমাদের গ্রামগুলোর অপর পাড়ে হওয়ায় শহরে যাতায়াত ছিল কিছুটা কষ্টসাধ্য, তবুও গ্রাম ছেড়ে কেউই শহরে বাস করতে চাইত না। কিছু কিছু যোথ পরিবার তাদের ছোট শিশু ও কিশোর’দের লেখা পড়ার চিন্তা করে একাংশ শহরে বাস করতেন। চাঁদনীঘাট থেকে শুরু করে শাবিয়া, বালিকান্দি, বলিয়ার ভাগ, ঢেউপাশা, মমরুজপুর, সম্পাসীর একাংশ সহ নদীর উত্তর পারের শিক্ষাত্রীদের জন্য কোন মাধ্যমিক বা উচ্ছ মাধ্যমিক স্কুল ছিল না, আমার জানা মত আজও নাই। নদীর এ পাড়ের\অণ্চলের মেয়েদের শিক্ষার প্রধান প্রতিবন্দকতা এই মনু নদী। যদিও যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে, গ্রীষ্ম, বর্ষা বা শীত বসন্তে নদীর দুই পারের পাকা রাস্থা দিয়ে ছোট বড় যান বাহন চলছে দিবা রাত্র। তার পরও এই পাড়ের মেয়েদের মাধ্যমিক ও উচ্ছ মাধ্যমিক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হয় নাই।
আমরা ছাত্ররা অর্ধেক দামের টিকেটে সিনেমা দেখতাম। আমার জীবনের প্রথম দেখা সিনেমা: রাখাল বন্ধু, কল্পনা সিনেমা হলে, সিনেমা দেখার কারনে বাবা হাতের মার খেতে হয়েছে। সামাজিক ধারনা ছিল ছেলে পুলেরা সিনেমা দেখলে বখাটে হয়ে যাবে তাই সিনেমা নিশিদ্ধ। জীবনে প্রথম প্রাইভেট গাড়ী (মিনি ভ্যান) চড়া হয় হাজী সৈয়দ তসলিম আলী লন্ডন থেকে চালিয়ে আসা মিনি ভ্যান গাড়ী। নিত্যদিন নৌকোয় পাড়াপাড় হতে হতো বলেই নিজে নদীর এপাড় ওপাড় করতে কিছুটা শিখে ছিলাম। অগ্রাহায়ন শেষে পৌষ ও মাঘ মাসে ধান ক্রয়ের জন্য ক্রতারা আসত ঘোড়া নিয়ে, সেই ফাঁকে ঘোড়া চড়তে শিক্ষা হয়। প্রথম ৬৬তে দেখা উরোজাহাজ সিলেট বিমান বন্দরে। প্রথম রেল ভ্রমন ৬৭এ শ্রীমঙ্গল-ঢাকা- শ্রীমঙ্গল। মুরির টিন বাস চড়া হতো প্রায়ই শহর থেকে বালিকান্দি ঘাট পর্যন্ত, সিলেট বাস ষ্টেন্ডের দ্বায়ীত্বে ছিলেন আমাদের এক কমন নানা মরহুম এ্যাডভোকেড গজনফর আলী চৌধুরীর পিতা মরহুম আব্দুল বারী চৌধুরী। বাড়ী যাবার পথে সিলেটি বাস ষ্টেন্ডে দাঁড়িয়ে দেখতাম, এখন কোন বাস ছারবে কি না? বাস ছারার লক্ষন দেখলেই নানার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম, নানা ঠিকই বুঝে ফেলতেন এবং বলতেন দাঁড়া, দেখি কি করা যায়? বাস ছাড়ার সময় আমাদের বাসে উঠিয়ে দিয়ে ড্রাইভার ও হন্ডুল ম্যানকে বলতেন বালিকান্দির ঘাটে নামাই দিছ। সে সময়ে আমছইল (হানছইল) নামে মৌলভীবাজার সিলেট রোডে একটি বাস চালো ছিল।আসলে ঐ বাসটি মেইল (ডাক) নিয়ে চলাচল করত বিধায় খুব ঘন ঘন থামতো তাই মেইল বাসটিকে আমছইল নামে ডাকা হতো। আমছইল বাসের হেন্ডুল ম্যান একজন ছিলেন মাছই ( নান্টু ভুল হলে ক্ষমা প্রার্থী) নামের, যিনি রানীর ভাউচারে লন্ডন গিয়ে ছিলে কিন্তু মানষিক অশান্তি ও ভাগ্যের পরিহাসে দেশে ফেরত আসেন এবং পরবর্তী জীবন মানষিক ভারসাম্য হীনতায় কাটান।
মৌলভবীজার সিলেট রোডটি ষাটের দশকেই নির্মিত হয়েছিল। রাস্থার উপর বড় বড় বোল্ডার পাথর বিছিয়ে রাখা ছিল বহু দিন। সাইকেল, রিক্সা এমন কি বাস ঠিক মত চলাচল করতে পারতো না। সাঁইকেল ও রিক্সা রাস্থার দু পাশের এক পাশদিয়ে চলতে হতো। বাসে সিলেট দুটি ফেরী শেরপুর এবং শাদীপুর জোড়ানৌকায় (জুরীন্দা) পার হতে হতো। সিলেট জেলার তৎকালীন রিক্সার হুড উপরের দিক চৌকোনার মত ছিল, আজকের মত অর্থাৎ বাংলাদেশ অন্যান্য এলাকার মত গোল ছিল না। চৌকোনা গুড়ের নীচে স্বাচ্ছন্দে বসতে যেত, গোল গুড়ের নীচে ঘার বাঁকা করে বসতে হত। এই চৌকোনা আর গোল গুড়ের কারন কি? সম্ভবত সিলেটের বাঁশের প্রকৃতিগত কারনে হয়েছিল চৌকোনা বানানো সম্ভব হতো।
সিলেট এলাকায় বহল প্রচারিত কথার কথা (প্রবাদ) ছিল “লন্ডনির পুয়াইন মানুষ অইন না (লেখা পড়া করে না)”। কথাটা অনেকাংশেই সত্য, কারন পুরুষ অভিবাবকের অভাব। সে সময়ে আমাদের কাছে ইউনাইটেড কিংডম লন্ডন নামেই পরিচিত ছিল। লন্ডন প্রবাসীদের প্রায় ৯৯%এর পরিবার দেশে ছিলেন যদিও আজ সম্পুর্ণ বিপরীত। আমাদের সমসাময়িক অনেকেই বয়-ভাউচারে লন্ডন পারি দেন যাদের মধ্যে হাতে গুনা ক’জন সেখানে উচ্ছ শিক্ষা গ্রহন করে, বাকীরা ব্যবসায় জড়িয়ে পরে। আমাদের ক্লাসমেট আব্দুল ওয়াহেদ ক্যামিক্যাল ইনি্জনিয়ারিং এবং সৈয়দ শামিম আহমদ গ্রাজুয়েশন করে অন্যরা সর্বউচ্ছ এ’লেভেল বা ও’লেভেল। দেশেও লন্ডন প্রবাসীদের সন্তানদের শিক্ষার হার খুবই নগন্য। তখনকার লন্ডন প্রবাসীদের ভাবনা/ধারনা ছিল ২/৪ বৎসর লন্ডনে রোজী রোজগার করে টাকা পয়সা নিয়ে দেশে চলে আসবেন। অনেকেই ২/৩ বৎসর পর পর দেশে ফেরত এসে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করেছিলে ঠিকই কিন্তু বাস্তবে সম্ভব হয় নাই। হাজী সৈয়দ তসলিম আলী (১৯৩৫ সাল থেকে লন্ডন প্রবাসী) বলতেন, “একবার যে বিদেশী- সারা জীবনই সে বিদেশী”। স্বাধীনতার পুর্বে অল্প সংখ্যক প্রবাসী পরিবার সহ লন্ডন বসবাস করতেন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে বিপুল সংখ্যায় প্রবাসীরা তাদের পরিবারকে লন্ডন নিয়ে যান। বর্তমানে প্রায় শতভাগ লন্ডন প্রবাসী পরিবার পরিজন নিয়ে তথায় বসবাস করছেন। দেশের অর্থনিতীতে লন্ডন প্রবাসী রিমিটেন্স যোদ্ধাদের অবদান অনস্বীকার্য। মুক্তিযাদ্ধে লন্ডন প্রবাসী সিলেটবাসীর সংগ্রীত পাউন্ড-ষ্টারলিংএ ক্রয়কৃত প্রথম যোদ্ধাস্র সরবরাহ করা হয়।
চলবে-
লেখাটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারন। আমি লেখা-লেখিতে অভ্যস্ত নয়। জীবনের শেষদিকে এসে অবসরে নষ্টালজিয়ায় পেয়ে বসেছে, তাই লিখার চেষ্ঠা। ভাষাগত ভ্রান্তি, বানান ও অন্যান্য অসংগতির জন্য ক্ষমা প্রার্থী।
|