হারুনূর রশীদ।।
মুক্তকথা: শনিবার, ১০ই অগ্রহায়ণ ১৪২৩।। দুনিয়ার মানুষ আজ এমন একজন মানুষকে হারালো যার কোন দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। চলমান শতাব্দীর সেরা এই মানুষ আজ ইহ লীলা সাঙ্গ করে অচেনা অনাদি অনন্ত এক সময়ের কোলে আশ্রয় নিয়েছেন। এই শতাব্দীর দুনিয়ায় তিনি ছিলেন দুনিয়া কাঁপানো বিপ্লবীদের সেরা ও সফল এক মহাশক্তিশালী অদ্বিতীয় রাষ্ট্রনায়ক। আধুনিক দুনিয়ার বিপ্লবের ইতিহাসে যে কয়েকজন মানুষের নাম বলা যায় তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন স্বীয় মহিমা ও কীর্তিতে উজ্জ্বল এক ব্যক্তিত্ব। বলছিলাম, কিউবা বিপ্লবের অমিত সাহসী চৌকুস নেতা এবং সে দেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রোর কথা। তিনি আজ প্রয়াত হলেন ৯০ বছর বয়সে। কিউবার কোটি কোটি মানুষের ভালবাসার মানুষ প্রবাদ প্রতিম এই নেতার চিতাভষ্ম শ্রদ্ধার সাথে সংরক্ষন করা হবে কিউবার দক্ষিন-পূবের শহর ‘সান্তিয়াগো দো কিউবা’র ‘সান্তা ইফিজেনিয়া সিমেটারি’তে। কিউবার শহীদ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সমাধীস্ত করার জন্য ১৮৬৮ সালে এই ‘সিমেটারি’ নির্মাণ করা হয়েছিল। কিউবার স্বাধীনতা সংগ্রামী বীর ‘জোস মার্তি’র শবভষ্মও এখানেই সমাহিত আছে।
ধনবাদী লগ্নীপুঁজির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতের নাগালে থেকে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে কিউবায় বিপ্লবী কমিউনিস্ট শাসন ধরে রেখেছিলেন তিনি। দুনিয়ার সেরা ধনবাদী শক্তি, আপ্রাণ চেষ্টা করেছে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার। কিন্তু দুর্বৃত্তদের সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে বার বার। প্রাণহানির চেষ্টাও হয়েছে বহুবার। তাঁর ৪৯ বছরের ক্ষমতায় আমেরিকার ১০ জন প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউসে এসেছেন গিয়েছেন। কাস্ত্রোকে সরাতে পারেননি কেউই। তিনি ছিলেন বিপ্লবী দুনিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী রাস্ট্র পরিচালক। ২০০৮ সালে ফিদেলের অবসরের পরও কিউবা শাসন করছে তাঁর প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টি।
ফিদেল কাস্ত্রো এক সফল রাষ্ট্র বিপ্লবের মধ্যদিয়ে দুষ্ট দূর্ণীতিবাজ বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করে ১৯৫৯ সালে কিউবার ক্ষমতায় আরোহণ করেন। সাধারণ কিউবানরা বলেন, কেস্ত্রো কিউবাকে, সত্যিকার অর্থেই কিউবার মানুষের হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
তার মূল নাম ছিল ফিদেল আলেসান্দ্রো কাস্ত্রো রুজ। জন্ম হয়েছিল ১৯২৬ সালের ১৩ই আগস্ট। তিনি ফিদেল কাস্ত্রো বা শুধুই কাস্ত্রো নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি আক্ষরিক অর্থেই সত্যিকারের এক অবিসংবাদিত সমাজ বিপ্লবী ছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী দুনিয়ায় যে সব বিপ্লবী নেতা বিশ্ব রাজনীতিতে প্রবলভাবে আলোচিত ছিলেন, ফিদেল কাস্ত্রো তাঁদের সকলের শীর্ষে ছিলেন। ১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট কিউবার এক ব্যবসায়ী পরিবারে ফিদেলের জন্ম হয়েছিল। ২১ বছর বয়সেই বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি দীর্ঘ গেরিলা যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ‘আমেরিকার পুতুল’ বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটিয়ে কিউবার ক্ষমতায় আসে তার দল। এই বিপ্লবে ফিদেলের প্রধান সহযোগী ছিলেন আর এক কিংবদন্তী চে গুয়েভারা। বিপ্লবের সংগ্রামে ছিলেন ফিদেলের ভাই এবং কিউবার বর্তমান প্রেসিডেন্ট রাউলও।
কিউবা বিপ্লবের নায়ক দৃঢ়ব্যক্তিত্বের ফিদেল কাস্ত্রো ফেব্রুয়ারি ১৯৫৯ থেকে ডিসেম্বর ১৯৭৬ পর্যন্ত কিউবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, এবং এরপর ফেব্রুয়ারি ২০০৮-এ তাঁর স্বেচ্ছায় সরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কিউবার মন্ত্রী পরিষদের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি কিউবা কমিউনিস্ট দলের প্রধান হিসেবে ১৯৬১ সালে দলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন। এর আগে শারীরিক অসুস্থতার কারণে ২০০৮ সালে তিনি তাঁর দায়িত্ব ভাই রাউল কাস্ত্রোর কাছে অর্পণ করেছিলেন। রাউল বর্তমানে কমিউনিস্ট পার্টির সহকারী প্রধান এবং মন্ত্রী পরিষদের প্রধান হিসেবে আছেন। এর আগে তিনি ১৯৫৯-২০০৮ পর্যন্ত ফিদেলের মন্ত্রী সভায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন।
হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়ার সময়, ফিদেল কাস্ত্রো তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। এরপর কিউবার রাজনীতিতে একজন বিখ্যাত ব্যক্তিতে পরিণত হন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় প্রেসিডেন্ট ফালজেন্সিও বাতিস্তা এবং কিউবার উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাবের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী সমালোচনা নিবন্ধ লিখে। তিনি এ ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। অবশেষে তিনি ১৯৫৩ সালে মনকাডা ব্যারাকে একটি ব্যর্থ আক্রমণ করেন, এবং কারারুদ্ধ হন। পরে ছাড়া পান। এরপর তিনি বাতিস্তার সরকার উৎখাতের লক্ষে সংগঠিত হওয়ার জন্য মেক্সিকো যান। ফিরে আসেন ১৯৫৬’র ডিসেম্বরে আর শুরু করেন সরকার উৎখাতের কাজ।
শাসনভার হাতে নেয়ার পর ১৯৬৫ সালে তিনি কিউবা কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান হন এবং কিউবাকে একদলীয় সমজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে রূপ দেন। ১৯৭৬ সালে তিনি রাষ্ট্র ও মন্ত্রী পরিষদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি কিউবার সর্বোচ্চ সামরিক পদে আসীন ছিলেন।
২০১৬ সালের আজ ২৫ই নভেম্বর সৃষ্টির অনিন্দসুন্দর এই সমাজবিপ্লবী হাভানায় মৃত্যুবরণ করেন।
(তথ্যসূত্র: বিবিসি, উইকিপিডিয়া ও আনন্দবাজার)