ইন্দিরা গান্ধীর সমাধি সৌধ থেকে বেরিয়ে খুব কাছেই পেয়ে গেলাম রাজিব গান্ধীর সমাধিসৌধ। মা-বেটাকে খুবই কাছাকাছি রাখা হয়েছে। ইন্দিরার শত সাধনার ধন, নয়নের মণি রাজীব রত্ন গান্ধী। মায়ের চিতাভষ্মের কাছে পুত্রের চিতাভষ্ম রাখার উদ্দেশ্যেই হয়তো এভাবে করা হয়েছে।
কিন্তু পিতা ফিরোজ গান্ধীর কোন নাম নিশানা পেলামনা আশপাশে। অবশ্য বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারণ তিনিতো আর ভারতের রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন না। না থাকলেও, জরস্ত্রিয়ান ধর্মাবলম্বী ফিরোজ গান্ধী ছিলেন সেই সময়কার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নবীন সদস্য। পরে ১৯৫১ সালে রায়বেরেলি থেকে ফিরোজ গান্ধী ভারতের প্রথম সাংসদদের একজন হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি একজন খ্যাতিমান সাংবাদিকও ছিলেন। ফিরোজ ‘দ্য নাশনাল হেরাল্ড পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। রাজনীতির জন্য ইংরেজদের হাতে ফিরোজকে জেলবন্ধি জীবনও কাটাতে হয়েছিল। কিছু কিছু লেখায় আছে যে কেবলমাত্র শ্বশুরের মনোভাবের বিপরীতে গিয়ে সেই সময়ের সংসদে কথা বলার কারণে তাকে শুধু রাজনীতি থেকে সরে দাড়াতেই যে হয়েছিল তা নয়, ভালবাসার বিয়েও আর জোড়া লাগেনি। দ্বিতীয় দফায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৬০ সালে ফিরোজ ইহলীলা সাংগ করে পরপারে চলে যান।
আমরা অনেকেই জানি আবার কেউ কেউ হয়তো জানিনা যে রাজীবের জন্ম হয়েছিল ২০শে আগষ্ট ১৯৪৪ সাল আর তাকে গুপ্ত আততায়ীর হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল ১৯৯১ সালের ২১শে মে। তিনি ছিলেন ফিরোজ গান্ধীর জ্যৈষ্ঠ পুত্র। ভারতের এক বিশেষ রাজনীতিক পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল। দিল্লী আদালতের ডাকসাইটে উকীল মতিলাল নেহরু’র পুত্র ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা ও স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর নাতি ছিলেন এই রাজীব গান্ধী। আততায়ীর হাতে ১৯৮৪’র ৩১শে অক্টোবর মায়ের মৃত্যুর দিন মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে ভারতের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়ীত্বভার গ্রহন করেছিলেন রাজীব রত্ন গান্ধী।
রাজনীতিতে পদার্পণের পূর্বে রাজীব ছিলেন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের একজন পেশাদার বিমানচালক। কেমব্রিজে থাকাকালীন ইতালীয় বংশোদ্ভুত সোনিয়া মাইনোর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। পরে সোনিয়াকে বিবাহও করেন তিনি। মা দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও, ১৯৮০ সালে কনিষ্ঠ ভ্রাতা সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত রাজীব রাজনীতি থেকে দূরেই ছিলেন। ১৯৮৪ সালে অপারেশন ব্লু স্টারের প্রতিক্রিয়ায় আততায়ীর হাতে ইন্দিরা গান্ধী নিহত হলে জাতীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ রাজীবকেই দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করেন।
গরীবদের প্রতি আন্তরীক দয়াশীল রাজীব গান্ধী কংগ্রেসেরও সভাপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন। এ সময়, ভারত বর্ষের সংসদের ইতিহাসে সর্বকালের সর্ববৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কংগ্রেস পার্টি এক অভূতপূর্ব বিজয় লাভ করেছিল। ফলে, সরকারের ওপর গান্ধীর একাধিপত্য পাকাপোক্ত হয়ে উঠেছিল।
অনেকক্ষন তার স্মৃতি সৌধের সামনে দাঁড়িয়ে তার হত্যাকন্ডের মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক ঘটনার স্মৃতিতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। তাকে যেদিন হত্যাকরা হয় সেই অমানবিক জঙ্গী ঘটনা টেলিভিশনে দেখানো হয়েছিল। আমি বসে বসে সেই বর্বরোচিত হত্যাকান্ড দেখেছিলাম। তার সৌধের সামনে দাঁড়াতেই ওই দৃশ্যগুলো আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে। খুব ব্যথা অনুভব করি। ফিরে আসার সময় দেখি তার পবিত্র সৌধের সামনাসামনি কঠিন পাথরে খোদাই করে লিখে রাখা আছে কিছু কথা। কথাগুলো আধুনিক কাব্যিক ছন্দে হিন্দি আর ইংরাজীর সাথে বাংলায়ও লিখা আছে-
“আসুন গড়ে তুলি এক ভারত
স্বাধীনতা যার গর্ব
স্বাধীনতা রক্ষায় যে শক্তিশালী,
কৃষি, শিল্প ও প্রযুক্তিতে যে সবল, স্বনির্ভর, অগ্রণী
জাতি, ধর্ম, অঞ্চলের সীমা অতিক্রম করে ঘনিষ্ট
বন্ধনে আবদ্ধ;
দারিদ্র এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্যের
শৃঙ্খল মুক্ত,
সুশৃঙ্খল ও সুদক্ষ,
নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ,
পৃথিবীতে শান্তির এক নির্ভীক সৈনিক,
বৈষয়িক প্রগতির সঙ্গে মিলুক অন্তরের প্রশান্তি;
গড়ে তুলুক বিশ্ব সংগঠন,
আমাদের ঐতিহ্যের শক্তি, তরুণ বসন্তের
প্রাণোচ্ছলতা আর জনগনের অজেয় মনোবলে
শক্তিতে এক নতুন সভ্যতা।
-রাজীব গান্ধী”
লন্ডন: শুক্রবার, ২৬শে ফাল্গুন ১৪২৩