হারুনূর রশীদ।।
“আই উইল মেইক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর দি পলিটিসিয়ান্স…” এই বলেই প্রয়াত জিয়াউর রহমান তার রাজনীতির একপর্যায়ে খুবই স্বজ্ঞানে সুস্থমাথায় মুলতঃ মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরুধীদের নিয়ে গঠন করেছিলেন বিএনপি। ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানী জাতিগঠনের কাল্পনিক চিন্তায় পাকিস্তান যেমন তাদের নীতি নির্ণয় করেছিল যে তাদের অগ্রগতির অন্তরায় হবে ভারত।
অবশ্য পাকিস্তানের জন্য সেই নীতি নির্ধারণ কিছুটা হয়তো প্রয়োজন ছিল। কারণ পাকিস্তানের ধারক-বাহকরা ভাবতেন ভারতে মুসলিম রাজত্ব ছিল আর ইংরেজরা মুসলমানদের কাছ থেকে সেই রাজত্ব কেড়ে নিয়েছিল। সুতরাং স্বাধীনতা যখন এই ইংরেজরাই দেবে তা’হলে মুসলমানদের কাছেইতো ফিরিয়ে দেয়ার কথা। কিন্তু বাস্তব যে অনেক দূর চলে গেছে, সময় যে গড়িয়ে গেছে দু’শ বছরেরও বেশী সে চিন্তা পাকিস্তানী নেতাদের স্বার্থ হাসিলের কূটনীতিতে সঠিকভাবে কাজ করেনি। ফলে তারা তাদের নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে ভারতকে ভাগ করে নিতে রাজী হয় এবং গঠন করেন কল্পনিক দেশ পাকিস্তান। নীতিও সেই আদলে ঠিক করা হয়। ভারত শত্রু! ভারতকে মোকাবেলা করেই এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু হয়েছি কি? ঘন্ট আর কাঁচকলা!
আর সেই নীতিকেই শিরোধার্য করে প্রয়াত জিয়া বিএনপি’র নীতিকেও পাকিস্তানের আদলে সাজিয়েছিলেন। শুধু কি সাজিয়েছিলেন, শুনা যায় সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বন্ধু পাকিস্তানী শিল্পপতিদের ঢাকা ও চট্টগ্রামের ১০টি ছোট-বড় শিল্প কারখানা ফেরতও দিয়েছিলেন। হায়রে পাক প্রীতি! পাকিস্তানের সেই কল্পনার ভূত বিএনপি আজো মাথা থেকে নামাতে পারেনি।
এবার নতুন করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বললেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সাথে নতজানু হয়ে প্রতিরক্ষা বিষয়ক সমঝোতার যে গোলামির স্বাক্ষর করেছেন বাংলাদেশের জনগণ সেটি না-কি সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রতিরক্ষা বিষয়ক চুক্তি প্রসঙ্গে রিজভী আহমেদ বলেছেন, এই চুক্তিতে দেশের না-কি সম্মতি নেই। জনগণ না-কি এই চুক্তি বাস্তবায়ন হতে দেবে না। তিনি আরও বলেন-“আমরা আমাদের প্রতিরক্ষা নিজেদের মতো সুন্দর করে সাজাবো। ভারত বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভিতরে ঢুকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই এই চুক্তিটি করতে বাধ্য করেছে। গতকালের এই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।”
তিনি আরও বলেছেন- “ভারতকে মনে রাখতে হবে- তাদের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি বিশেষ একটি রাজনৈতিক দল তাদের অবৈধ ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য করেছে। এটি বাংলাদেশের নয়, এটি জনসমর্থনহীন একটি রাজনৈতিক দলের চুক্তি।”
রবিবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল আয়োজিত “৫৪ টি অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা চাই দেশ বিরোধী কোন চুক্তি মানি না” শীর্ষক এক মানববন্ধনে তিনি এ কথা বলেন। রিজভি’র এধরনের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আমাদের শুধু এই কথাটি বলতেই ইচ্ছে হয়-বিএনপি যখন ভারতের সাথে কোন চুক্তি করে তখন সেটা নতজানু হয়না। যত দোষ ওই বেটা নন্দ ঘোষের। ওই যে, যারে দেখতে নারি তার চরণ বাঁকা।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকে নিয়ে আগে থেকেই খালেদা জিয়ার বিএনপি ‘ভারত জুজুর’ ভয় দেখানো শুরু করেছিল যা তাদের সেই আগের মতই অতীব পরিচিত চিরাচরিত একটি ‘মরমি গীত’ বলতে হয়।
এর জবাবে অবশ্য ভারত সফরের ঠিক আগের দিন হাসিনাও বিএনপি’র ঢোল বাজিয়ে দিয়েছেন খুব ভাল করেই। বিএনপি’র আমলে গ্যাস বিক্রির বিষয় তুলে তিনি বলেছেন, ২০০১–এ তো আমেরিকার নির্দেশে ভারতকে তুষ্ট করেই বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল! ভারতকে গ্যাস বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় সেবার অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জিততে দেওয়া হয়নি।
গেল বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ২০০১ সালের ওই নির্বাচনে জিতে বিএনপি–র ক্ষমতায় যাওয়ার ঘটনাবলি তুলে ধরেছিলেন তিনি। ভারত সফরে যাওয়ার ঠিক আগের দিন ওই বৃহস্পতিবার ঢাকার ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ডিপ্লোমা কৃষিবিদ মহাসম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে সেই সময়ের ঘটনা বিস্তৃতভাবে জানিয়ে বিএনপি’কে পাল্টা আক্রমণ করেছেন হাসিনা। শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এল। আর সেই ক্ষমতায় আসার পেছনে বেশ ভাল একটা চুক্তি ছিল বাংলাদেশের সম্পদ গ্যাস নিয়ে। এই গ্যাস বিক্রি করতে চাইল আমেরিকা, কিনবে ভারত। আমেরিকান কোম্পানি বাংলাদেশের গ্যাস তুলবে, ভারতের কাছে বিক্রি করবে। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন গ্যাস বিক্রির প্রস্তাব তাঁর কাছেই দিয়েছিলেন জানিয়ে নিজেকে ওই “ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী” হিসেবে বর্ণনা করেছেন হাসিনা সেই সভায়। সভায় হাসিনা আরও বলেন, তখন আমি বলেছিলাম, আমাদের দেশে কত গ্যাস আছে, আমরা এখনও জানি না। আমাদের দেশের মাত্র সামান্য কয়েক শতাংশ মানুষ এই গ্যাসের সুবিধা পান।
ক্লিন্টনকে হাসিনা বলেছিলেন, দেশের সম্পদের মালিক জনগণ। আগে জনগণের চাহিদা আমাকে পূরণ করতে হবে। চাহিদা পূরণ করার পর ৫০ বছরের মজুত রাখবো ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য, তার অতিরিক্ত গ্যাস যদি থাকে, তখন আমরা তা বিক্রি করতে পারি। তার আগে বিক্রি করতে পারি না। হাসিনা সেদিন প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, পাকিস্তান আমলে বিদেশি কোম্পানির কাছে ইজারা দেওয়া প্রত্যেকটা গ্যাসফিল্ড বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নগদ টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে বাংলাদেশের সম্পত্তিতে রূপান্তরিত করেছিলেন।
২০০০ সালের ২০ মার্চ বাংলাদেশ সফরকারী প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেছিলেন বিল ক্লিন্টন। হাসিনার এ কথায় নিশ্চয়ই খুশি হননি মার্কিন প্রেসিডেণ্ট ক্লিন্টন। হাসিনা বলেন, বিএনপি সেসময়ই তাদের মুচলেকা দিয়েছিল, ক্ষমতায় গেলে গ্যাস তারা বিক্রি করবে। এর আগেও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, তিনি গ্যাস বিক্রি করতে রাজি হননি বলেই ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরিকল্পিতভাবে হারানো হয়েছিল।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ওই পরিকল্পনায় ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (র) এবং বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসের সরাসরি যুক্ত থাকার অভিযোগও তুলেছেন তিনি।
সবকথার শেষ কথা, পাকিস্তান আমল থেকে কত শুনে এসেছি- বাংলাদেশ ভারত নিয়ে নেবে, আমরা মুসলমান থাকতে পারবো না, মসজিদে নামাজ পড়তে পারবোনা ইত্যাদি ইত্যাদি কত কি! আর এসব নিয়ে তথাকথিত স্বার্থান্ধ আলেম সমাজের দাড়িতে মেহদি লাগিয়ে সে কি মিথ্যা বয়ান! তার কোনটিই যে ঠিক ছিলনা কেবল ভন্ডামো আর রাজনৈতিক মিথ্যা রটনা ছিল তা আজ সূর্যের মত পরিস্কার। বাংলাদেশের সুদীর্ঘ ৪৫-৪৬ বছরের ইতিহাস স্বচক্ষে দেখার পরও কি বিএনপিসহ ইসলামী দলগুলোর মগজ থেকে কাল্পনিক ভারত ভীতির সেই ভূত নামবে না! এখনও কি তারা অতীতের মত ডাহা মিথ্যাচার চালিয়ে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করেই যাবে! আর আমরা শুধু আঙ্গুল মুখে দিয়ে হাবার মত চেয়ে থাকবো।
রোববার, ২৬শে চৈত্র ১৪২৩।।