হারুনূর রশীদ।।
ধর্মানুরাগ সমর্থনযোগ্য। ধর্মান্ধতা এক ধরনের বর্বরতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সানদিক শিক্ষা নয়, সত্যিকারের জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত, পেছনে পড়ে থাকা, অনেকটা স্বার্থান্ধ মানুষজনই ধর্মান্ধ হয়ে থাকে। এ নমুনার মানুষ সে যেকোন সমাজেই হোক- সমাজ ও মানুষের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করে। ধর্মান্ধ মানুষ যেকোন সমাজের জন্য ভীতিকর অপাংক্তেয়।
ধর্মানুরাগ যেমন আদিতেও ছিল এর সাথে ধর্মান্ধতাও পাশাপাশি ছিল। যে কোন ধর্মের প্রতি অনুরাগ খুবই স্বাভাবিক। এটা মানুষের মাঝে থাকবেই। কিন্তু সেই অনুরাগ যখন পাশের একজনের ক্ষতি কিংবা মনোপীড়ার কারণ হয়ে উঠে তখন সে অনুরাগ থাকেনা, কোন একটা বিশেষ স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে অন্ধ হয়ে যায়। হয়ে যায় ধর্মান্ধতা। যা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে হত্যা করতে বিচলিত হয় না।
অতি সম্প্রতি আমাদের দেশে একটি ভাস্কর্য নিয়ে দেশের ধর্মান্ধগোষ্ঠী সরকারকে হুমকি দিতে সামান্যতম ভয় পায়নি কোন অন্যায়বোধও করেনি। এর আগে এই গোষ্ঠীই বিনা কারণে শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত কিছু স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে ঢাকা শহরকে নরক বানিয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশের ধর্মান্ধতার নমুনায় বেশ চমক আছে।
এখানে হাজারে হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্তরা যেভাবে অবলিলায় ঘুষ খেতে কোন অন্যায়বোধ করেনা ঠিক একইভাবে ওই লোকজন বলতে গেলে জেনেশুনেই ধর্মান্ধের কাজ করে। আমার বেশ মনে আছে, এদের মতই একজন ২০০৮ সালে মূর্তি আর ভাষ্কর্যের তফাৎ দেখাতে গিয়ে লিখেছিলেন-“…সকলের মধ্যে ইসলামী চেতনা কাজ করছে। সকলেই ইসলামকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনা ও গবেষণা করতে চাচ্ছে। তাই সকলে ইসলাম সম্পর্কে মতামত দিতে চায়।…।”
একটু হাসির বিষয় বটে। বাংলাদেশের জন্মের আগ থেকেই এই ভূখন্ডে ইসলাম ধর্মধারী মানুষ ছিল এবং আছে। ইসলামী জোশ আর চেতনার কোন কমতি কোনদিনই এখানে দেখা যায়নি। এর, সূর্যের মত খাঁটী উদাহরণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। এসময় এদেশেরই তথাকথিত জ্ঞানী-গুণীরা(আলেম-উলেমাগন) ইসলামী জোশ আর চেতনা থেকেই আমাদের মেয়েদের ‘মাল-এ-গণিমত’ আখ্যায়িত করে পাক বর্বর বাহিনীর ধর্ষণকে যুক্তিযুক্ত(জায়েজ) ঘোষণা দিয়েছিল।
এদের একজনের ‘টেপ রেকর্ড’ আমি নিজে শুনেছি যা এখনও বাংলাদেশেরই একটি রেডিও ষ্টেশনে সঞ্চিত আছে। নতুন করে এখানে ইসলামী চেতনা আর জোশের কথা বলা আমার কাছে ওই ধর্মান্ধতারই পরিচায়ক। একই বিষয়ে তিনি আরো লিখেছিলেন-“…যদি বিষয়টি নৈতিবাচক দিক দিয়ে নেয়া হয়, তাহলে বলতে হয়, বিষয়টি খুবই বিপদ-জনক। যাদের ইসলাম সম্পর্কে ভাল জ্ঞান নেই, তারা যদি ইসলাম সম্পর্কে ফতোয়া দিতে শুরু করে, তাহলে ইসলাম অবিকৃত থাকার বিষয়ে হুমকি সৃষ্টি হয়। যেমনটি হয়েছে খৃস্ট ধর্মের ব্যাপারে।…।” তার এসব কথায় চাতুর্য আছে, আছে মুন্সিয়ানা! কিন্তু যা নেই তা’হলো সত্যনিষ্ঠতা। আমরা বুঝি, দুনিয়ার কোন ধর্মকেই কেউই কোন সময়ই বিকৃত করার চেষ্টা করেনি। ধর্ম মানেইতো একটি মতবাদ।
মানুষকে জীবন চালানোর কিছু ইশারা দেয়। এমন ইশারা একজন দিতেই পারেন। কিন্তু মানুষ যখন জীবন চলার পথে হোচট খায় তখনি সে চলার পথকে পরিস্কার করতে যায়। এ কাজ করতে গিয়ে সে তার নিজের মত করে জীবন চলার পথের জঞ্জাল সরায়। চলার পথকে সংস্কৃত করে। এতে ভিন্নজনের মনে করা ঠিক নয় যে ওই মানুষটি কোন বিশেষ ধর্মকে সংশোধন করছে। বরং ওই মানুষজন তাদের মঙ্গলার্থে নিজের মত করে জীবনযাত্রাকে সাজিয়ে নেয়ার কাজ করছে বলেই আমাদের দেখা উচিৎ। একাজকে আমরা ধর্মকে বিকৃত করা হচ্ছে বলে কেনো দেখতে যাবো! আমার ভাষায় এরূপ দেখা জায়েজ নয়।
ভাস্কর্য বিষয়টি আমাদের দেশের ইসলামী পড়ুয়ারা আদৌ বুঝতে শিখেননি। তাদের মনে কাজ করে নবী ইব্রাহীমের মূর্তি ভেঙ্গে ফেলার ঘটনাটি। আরো কাজ করে কাবা ঘর থেকে নবী মোহাম্মদ কর্তৃক মূর্তি অপসারণের ঘটনাটি। একাজে তারা কোন জ্ঞানসিদ্ধ যুক্তিতর্ক শুনতে আদৌ রাজী নন। কারণ একটিই তাদের জানার অজ্ঞতা। তারা দেখার, জানার কিংবা বুঝার চেষ্টাও করেন না যে, মাটিতে ইসলাম নামক মতবাদের জন্ম হয়েছে সেখানে সহ দুনিয়ার সকল ইসলাম প্রধান দেশগুলিতে ভাস্কর্য শুধু আছেই নয় ব্যাপকভাবে আছে।
সত্য ইতিহাসতো এই যে, ভাস্কর্যের চিন্তা ও নির্মাণ মূলত ইসলাম প্রধান দেশগুলির অতীত ঐতিহ্য। দুনিয়ার মানুষের ভাষ্কর্য নির্মাণের হাতেখড়ি তো তাদেরই হাতে। আরো সত্য কথা হলো মূর্তির নির্মাণ মানুষের অতি প্রাচীন একটি শিল্পকর্ম। এর মধ্য দিয়ে মানুষ তার মনের প্রকাশ ঘটায়। আঁকাআঁকি থেকে যেমন মানুষের শিক্ষার শুরু তেমনি মাটি দিয়ে বা পাথর কেটে কিংবা কাঠ কেটে মনের মত করে নমুনা তৈরী মানুষের সেই আদি শিক্ষারই পরিশিলিত রূপ। কোন একজনের বাধার কারণে সাময়িক সময় হয়তো কিছু মানুষ একাজ থেকে বিরত থাকতে পারে কিন্তু যুগ যুগ থাকবে তার ভাবনা যুক্তিসিদ্ধ নয়। আর দুনিয়ার মানুষ যে থাকছে না তাতো আর ঘটা করে বলার প্রয়োজনই নেই। মূর্তি শব্দে আমরা ধরে নেই গতবাঁধা কয়েকটি চেহারা বা ছবি আর তার সাথে রয়েছে মাথা নত করে সে মূর্তি বা ছবিকে প্রণাম বা সেজদা। যদিও মূর্তি শব্দের হুবহু ব্যাখ্যা এমন নয় বা হওয়া উচিৎ নয়। ভাষ্কর্য বলতে আমরা বুঝি শিল্পীর মনের আয়নায় দেখা মুরতির বিশেষ রূপ। তা হুবহু হতে পারে আবার রূপক হতে পারে। ভাস্কর্য নির্মাণ পূঁজা-অর্চ্চণার জন্য হয় না। যদিও মূর্তি আর ভাস্কর্য নির্মাণ কৌশলে কোন ব্যতিক্রম থাকেনা।