লন্ডন: গত দুইদিনের ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার অন্তত ৩০টি হাওর ও বিলের বোরো ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। বছরের একমাত্র বড় ফসল বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকদের মধ্যে হাহাকার শুরু হয়েছে। এছাড়া শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ি, ঝিনাইগাতি ও শ্রীবরদী উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের প্রায় অর্ধশত গ্রামের কমবেশি ৩ হাজার হেক্টর জমির বোরো আবাদ তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে শত শত পুকুরের মাছ। এদিকে, সুনামগঞ্জে গত শুক্রবার বিকালে ১০ হাজার হেক্টরের শনির হাওরের বাঁধে ফাটল দেখা দিলে জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে ২৫ হাজার বালুর বস্তা দিয়ে সেই ফাটল ঠেকান হয়। জামালগঞ্জের পাগনার হাওরও ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে সিলেট অঞ্চলে আরো কয়েক দিন বৃষ্টি হতে পারে। সব মিলিয়ে দারুণ দুশ্চিন্তায় আছেন হাওরপাড়ের বাসিন্দারা।
কেন্দুয়া (নেত্রকোনা) সংবাদদাতা জানান, শুক্র ও শনিবারের ভারী বর্ষণে উপজেলার কান্দিউড়া উগাইরিয়া বিল, জালালপুর হাওর, বোয়াল্লেহুরী বিল, চিরাং ইউনিয়নের কালিয়ান বিল, ধলেশ্বর বিল, বাগাটিয়া বিল, কুদ্দিঘা বিল, রোয়াইলবাড়ি আমতলা ইউনিয়নের মাছুয়াইল ও কাকিনা বিল, মাসকা ইউনিয়নের ধারাইল বিল, নওপাড়া ইউনিয়নের পুকুরিয়া হাওর, বউশন বিল, বাগজান বিল, পাঁচহার হাওর, কোনাপাড়া বুরুনদ্দি বিল, জুড়াইল ইটাচকি হাওর, বলাইশিমুল ইউনিয়নের বগাজান বিল, চড়ুই বিল, ভেকুয়ার হাওর, ভেকুয়ার বিল, কাইজনার বিল, কিছুরিয়ার বিল, ছবিলার হাওর, পুকুরিয়ার বিল, কুদিয়ার বিল ও রাজাইল বিলের বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সরকারিভাবে বড় ধরনের কোনো সহযোগিতা করা না হলেও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে নামমাত্র ১৫ কেজি করে চাল কোনো কোনো এলাকায় বিতরণ করা হয়েছে। তা-ও আবার ক্ষতিগ্রস্ত সকল কৃষক পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাসান ইমাম গতকাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে জানিয়ে বলেন, প্রতিদিনই উপজেলার নতুন নতুন হাওর-বিল তলিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এর আগে বাঁধ ভেঙে উপজেলার মোজাফরপুর ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় হাওর জালিয়ার হাওরের কয়েক হাজার একর জমির বোরো ধান ও একই ইউনিয়নের সুনুই বিলের ফসল পানিতে তলিয়ে যায়।
শেরপুর প্রতিনিধি জানান, জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলায় মহারশি নদীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে আশপাশের প্রায় ২০ গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। নালিতাবাড়ি উপজেলার চেল্লাখালি নদীর উত্তরে সন্নাসীভিটা এলাকায় ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ দিয়ে ঢলের পানি প্রবেশ করে প্রায় ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্ত এলাকার কর্ণঝোড়া এলাকার পাহাড়ি ঢেউফা নদীর ঢলে প্লাবিত হয়েছে ২ ইউনিয়নের প্রায় ১০ গ্রামের নিম্নাঞ্চল।
এসব এলাকায় ভেসে গেছে অসংখ্য পুকুরের মাছ, বিনষ্ট হয়েছে শত শত একর জমির বোরো ফসল, আকস্মিক পানিবন্দি হয়ে পড়েছে শত শত পরিবার। স্থানীয় কমিউনিটি ক্লিনিক, মসজিদ, ইউনিয়ন পরিষদ ও ঘরবাড়ি সবই বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। বেড়িবাঁধ সংস্কার না করায় শেরপুর-নালিতাবাড়ী সড়কের সন্নাসীভিটা বাজারে গাছের গুঁড়ি ও বাঁশ ফেলে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা।
ঝিনাইগাতী উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বাদশা পাহাড়ি ঢলে মহারশি নদীর তিন স্থানে ভাঙনের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, এতে অনেক এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। নালিতাবাড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোখলেছুর রহমান রিপন জানান, উপজেলার প্রায় ৪ ইউনিয়নে ঢলের পানি প্রবেশ করেছে। এতে প্রায় ১ হাজার হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ ব্যাপারে ঝিনাইগাতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ জেড এম শরীফ হোসেন জানান, ধারণা করা হচ্ছে— উপজেলায় এক হাজার পাঁচশ হেক্টর জমির ধানের ক্ষতি হয়েছে। তবে চূড়ান্ত ভাবে ক্ষতি নিরূপণ করতে আরো সময় লাগবে।
ত্রিশঙ্কু অবস্থায় সিলেটের হাওরবাসী: সিলেট অফিস জানায়, এক ভয়াবহ কঠিন সময় পার করছেন সিলেট অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠী। হাওর ডুবে গিয়ে বোরো ধান তলিয়ে গেছে। মাছ পচে মরছে। সেই হাওরের মাছ খেয়ে হাঁসও মরছে। এখন হাওরের ব্যাঙ, সাপসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদও মারা পড়ছে। জমিতে ধান নেই। কৃষকের ঘরে নেই চাল। গবাদি পশুরও খাবার নেই। পানির নিচে ধান গাছ পচে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে দুর্গন্ধ। অবশ্য প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে দুর্গন্ধ কিছুটা কমে আসছে। আবার বৃষ্টি নামলে রক্ষা পাওয়া হাওর ডুবে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি সংকটময় অবস্থা অতিক্রম করছে সুনামগঞ্জ জেলার অন্তত ২৫ লাখ লোক। এক ফসলি বোরো ছাড়া এই জেলায় বিকল্প কর্মসংস্থানেরও সুযোগ নেই।
কৃষি বিভাগের হিসাব মতে, এবার অকালবন্যায় সিলেটে বিভাগের সাড়ে ৩ লাখ কৃষক সরাসরি ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। সংকট কমাতে তাত্ক্ষণিক খাদ্য বিভাগ বিভিন্ন স্থানে ওএমএস কর্মসূচি চালু করেছে। তবে কর্মসূচিটি শুধু জেলা শহর ও উপজেলা শহরে চালু রয়েছে। অনেকেই বলেছেন গ্রামাঞ্চলে সংকট বেশি। তাই ইউনিয়ন পর্যায়ে ওএমএস কর্মসূচি চালু করা জরুরি। বরাদ্দ কম থাকায় সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলা সদরে ওএমএস’র ডিলারের চাল বিতরণ কেন্দ্র থেকে অনেক লোক শূন্য হাতে বাড়ি ফিরছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, গতকাল সকাল থেকে উপজেলায় মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। সেই সাথে বেড়ে চলেছে মেঘালয় পাহাড় ঘেঁষে প্রবাহিত জাদুকাটা নদীর পানি। এর প্রভাবে কৃষকদের শেষ ভরসা শনির হাওরে পড়তে পারে। সেই আশঙ্কায় আগে থেকেই শনির হাওর রক্ষায় স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে যাচ্ছেন এলাকাবাসী।
লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জানান, প্রবল বৃষ্টিতে ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে জেলার নিম্নাঞ্চলের সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর জমির রবি শস্য। নষ্ট হয়েছে সয়াবিন, বাদাম, মরিচ, বোরো ধান ও ডাল জাতীয় ফসল। গত চারদিনের প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে জমিতে পানি জমে নষ্ট হয়েছে এসব ফসল। কৃষকরা বলছেন, এবার লোকসানই গুনতে হবে তাদের। তবে ফসলি জমিতে জমে থাকা পানি দ্রুত বের করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে কৃষি বিভাগ।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, প্রবল বৃষ্টিতে ক্ষেতে ফসল নষ্ট হচ্ছে। ক্ষেত থেকে পানি সরিয়ে দিতে কৃষকদের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা পরামর্শ দিচ্ছেন।
দিনাজপুর অফিস জানায়, অবিরাম বর্ষণে দিনাজপুরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়েছে। গত ৯ ঘণ্টায় জেলায় ১০৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। দিনমজুরদের কর্মহীন থাকতে হয়েছে। বৃষ্টির ফলে রাস্তাঘাটে লোকজনের চলাচল ছিল কম। রাতে বিদ্যুত্ চলে যাওয়ায় গতকাল দিনাজপুর শহর থেকে ৯টি সংবাদপত্র প্রকাশ হয়নি। -ইত্তেফাক