‘মৃত্যু’ জীব জগতের এক অমোঘ সত্য। সৃষ্টির আদিকাল থেকে জন্ম আর মৃত্যুর সমান্তরাল ধারা বয়ে আসছে, এ যেন প্রকৃতির এক কঠিন খেয়াল। পরকাল কিংবা মৃত্যু-যন্ত্রণা নয় বরং জীবনের প্রতি মায়া’ই প্রানী জগতের মৃত্যু-ভয়ের প্রধান কারণ। তাই, এই অবিসম্ভাবী কাল’কে এড়াতে আমাদের কতোই না প্রাণান্ত চেষ্টা। মৃত্যুকে নিয়ে মানুষ কতো গবেষণা, গান, কবিতা, তথ্য-তত্ত্ব তৈরি করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। সাধের জীবন শেষ হয়ে যাবে এটি যেন কোনভাবেই মানুষ মানতে চায় না, তাই মৃত্যুকে জয় করতে না পারলেও তৈরি করেছে মৃত্যু পরবর্তী আরো উন্নত জীবনের তত্ত্ব। মানুষের মৃত্যু ভয়কে কাজে লাগিয়ে মৃত্যু পরবর্তী উন্নত জীবনের ফর্মুলা বাতলে দিয়ে অনেক মানব হয়ে গেছেন মহামানব।
মৃত্যু আসলে কী, একটু বুঝার চেষ্টা করি। সাধারণ ভাবে যেকোনো জীবের মৃত্যুকে দুই ভাবে ভাগ করা যায় যথা; স্বাভাবিক মৃত্যু এবং অস্বাভাবিক মৃত্যু। জীবদেহ মূলত অসংখ্য অতি ক্ষুদ্র একক দ্বারা গঠিত, যার নাম কোষ (Cell)। প্রতি মূহুর্তে কোষ উৎপাদন এবং ধ্বংস হওয়া একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সময়ের বিবর্তনে একসময় জীবদেহে কোষ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়, অন্যদিকে কোষের মৃত্যু অব্যাহত থাকে, এই ভাবে শরীরের সর্বশেষ কোষটির মৃত্যু হচ্ছে একটি জীবের স্বাভাবিক মৃত্যু।
আবার, যেকোন কারণে স্বাভাবিক মৃত্যুর আগেই মৃত্যু হওয়া হচ্ছে অস্বাভাবিক মৃত্যু। অক্সিজেন হচ্ছে প্রাণী দেহের জ্বালানি, এক্ষেত্রে কোন কারণে কোষে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে, জ্বালানি বা শক্তির অভাবে দেহের সকল কোষ একসাথে নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে এবং প্রাণীর মৃত্যু ঘটে।
আমরা যদি মানুষের কথা চিন্তা করি, অন্যান্য প্রাণী দেহের মতোই মানবদেহ অসংখ্য কোষ দ্বারা গঠিত। কোষ হচ্ছে জীবদেহের ক্ষুদ্রতম জীবিত একক যা দেহের গঠন, বিপাকীয় ক্রিয়াকলাপ এবং বংশগতির তথ্য বহনকারী। আবার এই একককে পরিচালনার জন্য বা জীবিত রাখার জন্য শক্তি প্রয়োজন হয়, এজন্য প্রতিটি কোষেই শক্তি উৎপাদনের জন্য রয়েছে এক বা একাধিক জেনারেটর (Mitochondria), তাই প্রতিটি কোষকে এক একটি শক্তি কেন্দ্র বা Power House বলা হয়। সহজ ভাবে বললে, জেনারেটর চালু তো আপনি চালু (জীবিত), জেনারেটর বন্ধ আপনিও বন্ধ (মৃত)। সাধারণত একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের দেহে কয়েকশো ধরনের ৩৭ ট্রিলিয়ন এর অধিক কোষ রয়েছে। এক এক ধরনের কোষের জীবনকাল এক এক রকম। প্রতি সেকেন্ডে একজন মানুষের দেহে প্রায় এক মিলিয়ন কোষ মারা যায় এবং প্রায় সম পরিমান কোষ জন্ম নেয়। আমাদের দেহে এক বছরে যে পরিমান কোষ মারা যায় তার ওজন আমাদের শরীরের মোট ওজনের প্রায় সমান। প্রতি ৭-১০ বছরে আমাদের দেহের প্রায় সব কোষ (কিছু স্থায়ী কোষ ব্যাতিত) প্রতিস্থাপিত হয়। মানুষের দেহের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী কোষ হচ্ছে মস্তিষ্ক এবং চোখের লেন্স কোষ, যা আজীবন অপরিবর্তিত থাকে।
পূর্বে শ্বাসতন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হলেই মানুষকে মৃত হিসেবে ঘোষণা করা হতো কিন্তু আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রে মৃত্যু বলতে বুঝায় মস্তিষ্কের মৃত্যু (Brain Death or Biological Death), কারণ মস্তিষ্কের কোষ শেষে মারা যায় এবং মস্তিষ্কের কোষ মারা যাওয়ার পর অন্য কোন কোষ Regenerate হওয়ার সুযোগ থাকেনা। অর্থাৎ মৃত্যু মানে একটি প্রাণী দেহে বিদ্যমান প্রতিটি কোষের আলাদা আলাদা মৃত্যু।
উপরের আলোচনা থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, মানুষ বা যেকোনো প্রাণীদেহের কোন নির্দিষ্ট স্থানে প্রাণ থাকে না, দেহে বিদ্যমান প্রতিটি কোষই প্রাণকোষ। একই দেহে প্রতিনিয়ত জীবের জন্ম এবং মৃত্যু হচ্ছে। গ্রীক দার্শনিক হেরাক্লিটাস বলেছিলেন, “You cannot step into the same river twice, for other waters are continually flowing on”. একইভাবে গতকালের আমি আর আজকের আমি এক নয়। শুধুমাত্র মস্তিষ্কের কোষের স্থায়ীত্বের কারণেই আমরা একক জীবন ভেবে থাকি।
একটি কমন প্রশ্ন মানুষ বা জীবের মৃত্যুর সময় বা ক্ষণ কি পূর্ব নির্ধারিত?
উত্তরঃ অবশ্যই পূর্ব নির্ধারিত নয়।
প্রথমেই আসি অস্বাভাবিক মৃত্যু প্রসঙ্গে। মনে করেন একটি মোমবাতি স্বাভাবিক ভাবে ৩০ মিনিট ধরে জ্বলতে পারে কিন্তু যদি হঠাৎ জোরে বায়ু প্রবাহিত হয়, তাহলে অবশ্যই এটি সাথে সাথে নিভে যাবে কিন্তু যদি বাতিটিতে আড়ালের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে তা অবশ্যই পুরো ৩০ মিনিট জ্বলবে। মানুষ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি ঘটিয়ে মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু অনেকটা কমিয়ে আনতে পেরেছে। যার ফলে বিগত একশো বছরে মানুষের গড় আয়ু প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে স্বাভাবিক মৃত্যুর সময় কি পূর্ব নির্ধারিত? এর উওরও হচ্ছে ‘না’। কারণ কোষের আয়ুষ্কাল প্রাণীর খাদ্যাভ্যাস, আবহাওয়া, ভৌগোলিক পরিবেশসহ অনেক কিছু দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।
যে প্রশ্নটি মানুষকে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ভাবিয়েছে তা হচ্ছে, মৃত্যুর পর মানুষের কি হয়?
এক কথায় উত্তর হচ্ছে, মানুষ জীবিত অবস্থায় তার শরীরের মৃত কোষ গুলোর যে পরিনতি হয়েছে, এক্ষেত্রেও তাই হবে অর্থাৎ যে প্রকৃতি থেকে মানুষের সৃষ্টি, মৃত্যুর পর আবার প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে যাবে। একটু ব্যাখ্যা করা যাক, ধরুন একটি মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করা হলো, নির্দিষ্ট সময় জ্বলার পর এই মোমবাতিটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেল। প্রশ্ন হচ্ছে, এই মোমবাতি গেল কোথায়? বিজ্ঞানের ভাষায় এটা হচ্ছে শক্তির রুপান্তর। আমাদের চারপাশে যা কিছু অস্তিত্বশীল সবই নশ্বর, শুধুমাত্র শক্তি (Energy) অবিনশ্বর। শক্তি সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না, শুধুমাত্র রুপান্তরিত করা যায়। বাস্তব বস্তু (Concrete Object) মোমবাতি তাপশক্তি, আলোকশক্তি প্রভৃতি শক্তিতে রুপান্তরিত হয়ে গেছে। যদি মানুষের কাছে উপযুক্ত ম্যাকানিজম থাকে, তাহলে এই অদৃশ্য মোমবাতি আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব। অর্থাৎ শক্তিকে বস্তুতে, একইভাবে বস্তুকে শক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব। মহাবিশ্বের সকল বস্তুই শক্তির আধার মাত্র। এখন পর্যন্ত আবিস্কৃত বিজ্ঞানের সবচেয়ে শক্তিশালী সূত্রগুলোর একটি হচ্ছে পদার্থ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের
E = mc2 equation, the theory of special relativity that expresses the fact that mass and energy are the same physical entity and can be changed into each other. In the equation, the increased relativistic mass (m) of a body times the speed of light squared (c2) is equal to the kinetic energy (E) of that body.
সুতরাং, মৃত্যু মানে শক্তির রুপান্তর মাত্র, মৃত্যু মানে প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়া। আবার সেই রুপান্তরিত শক্তি আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে যেকোনো প্রাণী, উদ্ভিদ অথবা জড় পদার্থেও স্থিতি লাভ করতে পারে। এটি অন্যান্য প্রাণী জগতের জন্য যেমন সত্য, মানুষের জন্যও সত্য।
উল্লেখ্য, শ্রীমদভগবদগীতায় আত্মার যে অবিনশ্বরতাবাদ বর্ণনা করা হয়েছে, তা অনেকটা আধুনিক শক্তির অবিনাশীতাবাদ এর সাথে মিলে যায়।
অন্তবন্ত ইমে দেহা নিত্যস্যোক্তাঃ শরীরিণঃ
অনাশিনোহপ্রমেয়স্য তষ্মাদ্ যুধ্যস্ব ভারত॥
শ্রীশ্রী গীতা,০২/১৮
অর্থাৎঃ আত্মা যে দেহকে আশ্রয় করে অবস্থান করেন, সেই দেহ নশ্বর কিন্তু আত্মা নিত্য, অবিনাশী ও প্রমাণের অতীত।
সর্বশেষ আলোচ্য বিষয়, মানুষের দ্বারা কি অমরত্ব লাভ সম্ভব?
আমার উত্তর, হ্যাঁ সম্ভব।
বিষয়টি কতোটা নৈতিক কি অনৈতিক সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু মানুষ সেদিকে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। প্রাণী কোষের ক্লোনিং অনেকটা রঙিন ফটোকপি করার মতো, যাহাতে পূর্বের বডির (যে শরীর থেকে কোষ ক্লোনিং করা হয়েছে) সকল জেনেটিক এবং ফিনোটাইপিক (বাহ্যিক গঠন) বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে। এখন শুধুমাত্র মূল বডির মস্তিষ্ক থেকে নতুন বডির মস্তিষ্কে স্মৃতি স্থানান্তর করতে পারলেই হলো। উল্লেখ্য, মস্তিষ্কের সাথে মেশিনের সংযোগ স্থাপনের প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে অনেক দূর এগিয়েছে। এতে করে একই স্মৃতি সম্পন্ন, একই আকৃতির, একই জিনগত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মানুষ তৈরি হবে।
একটু বুঝিয়ে বলা যাক; ধরি, এক ব্যক্তি চল্লিশ বছর বয়সে তার কোষ ক্লোনিং করে নতুন বডি জন্ম দিলেন (আলোচনার সুবিধার্থে ‘বডি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে)। ওই ব্যক্তির বয়স যখন ষাট হবে, তখন ক্লোন করা বডির বয়স হবে বিশ। এখন পূর্বের বডির স্মৃতি যদি ক্লোন করা বডির মস্তিষ্কে স্থানান্তর করা যায়, তাহলে ওই নতুন বডি হবে পূর্বের বডির ষাট বছরের স্মৃতিসহ বিশ বছরের যুবক। এমতাবস্থায়, আগের বডির মৃত্যু হয়ে গেলেও কোন সমস্যা নেই। এভাবে বডি পরিবর্তন করে, স্মৃতি ধরে রেখে শত শত বছর নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।
জন্ম, মৃত্যু আর সৃষ্টির রহস্য উদঘাটনে মানুষের অনন্ত প্রচেষ্টা অবশ্যই অব্যাহত থাকবে চিরকাল। কিন্তু ভয় দেখিয়ে, কল্প কাহিনী আর মিথ্যার মায়াজাল সৃষ্টি করে, মানুষকে দাস বানিয়ে রেখে সভ্যতার অগ্রগতি স্থবির করার কোন মানে হয় না।
সুরঞ্জিত দাস, ঢাকা
১৮/০৬/২০২১
|