সাতসমুদ্র তেরো নদীর ওপারে গিয়ে আবাস গড়ে তোলা জালাল উদ্দীনকে নিয়ে আমাদের ছোট্ট কাহিনীর দ্বিতীয় অংশ।
(২)
জালালুদ্দীনের কাছে আমি জানতে চাইলাম তার বাবা মুনির উদ্দীনের বিষয়ে।
দিনটি ছিল সোমবার আগষ্টের ১৬ তারিখ। কুচার মহলের ফকরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে রওয়ানা হলাম জালাল উদ্দীনের বাড়ীর উদ্দেশ্যে। ফকরুল ইসলাম জালাল উদ্দীনের চাচাতো ভাই। ফকরু নিজেই একদিন আমাকে জানালো সে জালাল উদ্দীনকে দেখতে যাবে। চাইলে আমি তার সংগ নিতে পারি। এমন একটি সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিলাম আমি। সাথে সাথেই রাজী হয়ে গেলাম।
লণ্ডনের বহু ধনী এলাকার একটি ‘নর্থ উড হীল’। এমনিতেই এদেশে অধিকাংশ ধনী মানুষজন গ্রামে বাস করে। গরীবরাতো গ্রামে বাস করেই। তবে অধিকাংশ গরীব শহরের অলি-গলিতে বাস করে। ধনবাদের বিকাশের সাথে সাথে এদেশের গরীব লোকজনকে পেটের দায়ে কাজের তাগিদে গ্রামের চিরাচরিত মনোরমা আত্মমুগ্ধকরা পরিবেশ ছেড়ে শহরে উঠে আসতে হয়েছে। অভিশপ্ত ধনিকতন্ত্রের এটিও একটি ধারা। পুঁজিবাদ বা ধনবাদ বিশ্বব্যাপী এমন ধারায়ই কাজ করে।
ফকরুদ্দীন আমার ছোট ভাইয়ের বয়সী। সেই ছোটবেলা থেকেই তার সাথে পরিচয়। খুব সাংস্কৃতিমনা মানুষ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রয়াত জলিল(আমেরিকায় বাস করতো) , ফকরু ও বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে, অনেকটা, বলতে গেলে সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করি। গ্রামে-গঞ্জে গিয়ে নাটক করেছি, শুধুমাত্র আমাদের সংস্কৃতিকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে শহর-গ্রামের আনাচে কানাচে মানুষের মাঝে পৌঁছে দেয়ার এক অজানা-অজ্ঞাত আকর্ষণ থেকে। জুড়ি থেকে বড়ইউড়ি আর শেরপুর থেকে সমশের নগর, খাঁচা ছাড়া পাখীর মত বনবাদারে উড়ে বেরিয়েছি সংস্কৃতিকে হৃদয়ে ধারন করে। আমি যখন বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে জুড়িতে নাটক করছিলাম সে রাতেই আমার প্রানপ্রিয় মা এ ধরাধামের মায়া ত্যাগ করে স্বর্গের পথে রওয়ান দিয়েছিলেন। দূর্ভাগা আমি মা’কে তার মৃত্যুসজ্জ্বার পাশে বসে দেখার সৌভাগ্য পাইনি। প্রিয়দর্শিনী আমার এই জননীই নিজের জীবনের বিনিময়ে আমার জীবনকে গড়ে দিয়েছিলেন। অতি অল্প বয়সে দুরারোগ্য কর্কটরোগে আমার মা মারা যান। এই মা-ই আমার সাংস্কৃতিক মন গড়ে দিয়েছিলেন সেই দুর অতীতের বাল্যে। মা সারাদিন বাড়ীতে থেকে সকল কাজে গুনগুনিয়ে রাধারমনের গান করতেন। বহু রাত, বহু দিন মায়ের কাছে বসে মন্ত্রমুগ্ধের মত গান শুনতাম। মা ঘরে গান গাইতে গাইতে রান্না-বান্না করতেন। তখন আমিই ছিলাম পরিবারে মায়ের একমাত্র সাথী।
সংস্কৃতির এই অঘোষিত আন্দোলনে শরিক হতে কেউ শিখিয়ে দেয়নি, বলেও দেয়নি। নিজে থেকেই কেনো জানিনা মনে হয়েছিল সারা পাকিস্তানী আমলে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি এক অন্ধ ধর্মীয় গোড়ামীর আলখেল্লার ভেতরে বন্দী হয়ে গিয়েছিল। আমার মনে আছে পাকিস্তানী আমলে আমরা একটি দেশপ্রেম মূলক নাটক করতে গিয়ে স্থানীয় ডিআইবি থেকে অনুমতি পাইনি। নজরুল জয়ন্তী করতে গিয়ে আমাদের নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছিল অনুষ্ঠানে কি কি আমরা পরিবেশন করতে পারবো। সম্ভবতঃ সেসব কারণ থেকেই স্বাধীনতার পর মনে এমন চেতনার উদয় হয়েছিল। সে সময়ের ডিআইবি ওয়াচার আমার শ্রদ্ধেয় হাবিবুর রহমান(হাবিব ভাই, জানিনা এই মানুষটি এখন জীবিত আছে কি-না) আমাদের খুব সুনজরে রাখতেন। আগে ভাগে অনেক কিছু বলে দিতেন। এই হাবিবুর রহমান, নিজের জীবনের দায় নিয়ে ২৬মার্চ ১৯৭১ইং তার বাসার আলমারীর পেছনে আমাকে লুকিয়ে রেখে পাকজান্তার হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিলেন। |