সুমন, ঢাকার উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন বলে লিখেছেন তার ফেইচবুকে। আরো লিখেছেন, তিনি রামগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়েও পড়েছেন। তাকে আমি চিনিনা। তবে তিনি আমার ফেইচবুকে আছেন। মাঝে-মধ্যে তার লিখা চোখে পড়ে। সুমন রাজনৈতিক সচেতন মানুষ তার লেখা থেকেই বুঝা যায়। তার লেখনি উচ্চমার্গীয় ক্ষুরধার না হলেও লেখায় একটা ঝাঁজ আছে। আমাদের উপর তার অন্তহীন ক্ষোভ। ক্ষোভ তার নিজের উপরও। আমরা বাঙ্গালীদের বিষয়ে তার একটি মূল্যায়ন যদিও সঠিক নয় তবে এ যে তার অন্তহীন ক্ষোভ থেকে এসেছে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। আর ক্ষোভ যে তার অহেতুক নয় তা ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। কথায় যেমন আছে, ‘বুদ্ধীমানের জন্য ইংগীতই যথেষ্ট’ তার ক্ষোভের কারণে এটুকু বলে রাখাই যথেষ্ট মনে করি।
তার বয়স আমার জানা নেই তবে তার একটি নির্দিষ্ট লেখা থেকে অনুমান করতে পারি তিনি হয়তো চল্লিশের কোঠার মানুষ। সে বয়স তিরিশ হোক বা চল্লিশ হোক, পর্যবেক্ষন থেকে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য এ বয়স যথেষ্ট। যে পারিপার্শিকতার মধ্যে থেকে তিনি বড় হয়েছেন আমার ধারণায় তিনি হটকারি আর চাটুকার মানুষের বৃত্তে ঘুরপাক খেয়েছেন বেশী, জীবনের উত্তরণে। হয়তো সে কারণেই জাতিগতভাবে আমাদের বিষয়ে তার ওই ঘৃণ্যতম মনোভাবের জন্ম হয়েছে। তার পর্যবেক্ষনকে তুচ্ছ মনে করছি না ঠিকই কিন্তু সর্বান্তকরণে গ্রহন করে নিতেও দ্বিধান্বিত আমি। তিনি যে মানদন্ড দিয়ে জাতি বিচার করতে গেছেন সে মানদন্ড ব্যর্থতার দুঃখ-বেদনা থেকে জন্ম নেয়া রাগ আর ঈর্ষার আস্তরণে ঢাকা পড়ে আছে। তাই আসল সত্যকে মিথ্যা থেকে বের করে নিয়ে আসতে বিপাকে পড়ে গেছেন। তিনি ১৭৫৭ এর পলাশীর সেই ঐতিহাসিক যুদ্ধ আর নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরিনতিকে যে মন ও চোখে দেখে তিনি বাঙ্গালী জাতি সমাজের যে চিত্র নিজের মণিকোঠায় গড়ে তুলেছেন তাকে ধোঁয়েমুছে একটু স্বচ্ছ করে নিলে আসল সত্যে পৌঁছতে পারতেন। তিনি তার পর্যবেক্ষনকে যে ভাব ও ভাষায় প্রকাশ করেছেন তা হুবহু নিচে তুলে দেয়া হলো-
“নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে যখন গ্রেফতার করে টেনে হিচঁড়ে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন অসংখ্য মানুষ হা করে নিরব দর্শকের মতো সেই দৃশ্য উপভোগ করেছিলো । শুধু তাই নয়, পিঠে ছুরিকাঘাত করার পূর্বে নবাবকে কাটাওয়ালা সিংহাসন ও ছেড়া জুতা দিয়ে যখন অপমান করা হচ্ছিলো, তখন শত শত মানুষ সেই কৌতুকে ব্যাপক বিনোদিত হয়েছিলো ! মাস সাইকোলজিটা একটু খেয়াল করে দেখুন, এই জাতি দুইশো বছরের গোলামী সাদরে গ্রহণ করেছিলো ওভাবেই ।
একটি মজার তথ্য দেই । লর্ড ক্লাইভ তার ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লিখেছিল নবাবকে যখন ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল অপমান করতে করতে তখন দাঁড়িয়ে থেকে যারা এসব প্রত্যক্ষ করেছিল তারা যদি একটি করেও ঢিল ছুড়ত তবে ক্লাইভকে করুণ পরাজয় বরণ করতে হতো ।
আরো চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে, প্রায় ১০ হাজার অশ্বারোহী, ৩০ হাজার পদাতিক এবং অসংখ্য কামান-গোলাবারুদসহ বিশাল সুসজ্জিত সৈন্যবাহিনী নিয়েই পলাশীর ময়দানে এসেছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা । কিন্তু তার বিপরীতে রবার্ট ক্লাইভের সৈন্যসংখ্যা ছিলো মাত্র ৩ হাজার, যার মধ্যে ৯শ জনই ছিলো হাতে পায়ে ধরে নিয়ে আসা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর শৌখিন অফিসিয়াল সদস্য যাদের অধিকাংশেরই তলোয়ার ধরার মতো সুপ্রশিক্ষণ ছিলো না, কোন দিন যুদ্ধ করেনি ।
এতো কিছু জেনেও রবার্ট ক্লাইভ যুদ্ধে নেমেছিলো এবং জিতবে জেনেই নেমেছিলো। কারণ, রবার্ট ক্লাইভ খুব ভালো করেই জানতেন একটি হীনমন্য ব্যক্তিস্বার্থলোভী দ্বিধাগ্রস্ত জাতিকে পরাস্ত করতে খুব বেশি আয়োজনের প্রয়োজন নেই ; রক্ত-যুদ্ধ এইসব এদের জন্য মশা মারতে কামান দাগার মতো অবস্থা। যাদেরকে সামান্য দাবার চালেই মাত করে দেয়া যায়, তাদের জন্য হাজার হাজার সৈন্যের জীবনের ঝুকি তিনি কেনো নিবেন ? এছাড়াও, মীরজাফরকে যখন নবাবীর টোপ গেলানো হয়, রবার্ট ক্লাইভ তখনো জানতো যে, সিরাজকে পরাজিত করার পর এই বদমাশটিসহ বাকিগুলোর পাছায়ও লাথি দেয়া হবে এবং হয়েছেও তাই।
মীরজাফর, উমিচাঁদ, রায়বল্লভ, ঘষেটি বেগমসহ সবগুলোরই করুণ মৃত্যু হয়েছিলো।
না ভাই, রবার্ট ক্লাইভ মীরজাফরের বেইমানীর উপর ভরসা করে যুদ্ধে আসেনি। সে যুদ্ধে এসেছিলো বাঙালীর মানসিকতা ও ভূত-ভবিষ্যতসহ বহুদূর পর্যন্ত নিখুঁতভাবে আন্দাজ করে। সে জানতো, মীরজাফরকে টোপ দিলে গিলবে এবং কাজ শেষ হলে লাথি দিবে।
সে জানতো, যুদ্ধশেষে জনসম্মুখে নবাবের পাছায় লাথি দিলেও এই জাতি বিনোদনে দাঁত কেলাবে, অথবা হা করে সব চেয়ে চেয়ে দেখবে। বিনা দ্বিধায়ই সার্টিফিকেট দেয়া যায়, বাঙালী জাতির কদাকার মানসিকতা সবচেয়ে নিখুঁতভাবে মাপতে পারা ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তিটির নাম রবার্ট ক্লাইভ ….!”
লন্ডন: রোববার,
১১ই অগ্রহায়ণ ১৪২৩