আমি একাত্তর দেখেছি। ১৯৭১ এর নয়মাস ব্যাপী মহান মুক্তিযুদ্ধ আমি যে ভাবে প্রত্যক্ষ করেছি সেই স্মৃতিটুকুই তুলে ধরতে চাই। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর আমি যা দেখেছি শুনেছি সেই সত্য টুকুই তুলে ধরার তাগিদ অনুভব করছি। কিশোর বয়সে দেখা নয় মাসের সেই ভয়াল দিন গুলোর কথা পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চাই। আর কেন চাই তারও একটি বিশেষ কারণ রয়েছে। যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল তারাই অত্যন্ত সুকৌশে ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা করছে। শুধু ইতিহাস বিকৃতিই নয় নতুন করে কোন কোন মহলকে বলতে শুনি বাংলাদেশ নাকি ইসলামিক রাষ্ট্র! এসব শুনলে মনে দারুন কষ্ট পাই। যারা এসব বলে তারা জাতীয় সঙ্গীত পছন্দ করেনা, শহীদ দিবস, বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসে এদের শহীদ বেদীতে শ্রদ্ধা জানাতেও দেখা যায়না। মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ায়। জয় বাংলা বলতে দ্বিধাবোধ করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট জাতির জনককে স্বপরিবারে হত্যার পর এরাই সব থেকে বেশী আনন্দিত হয়েছিল। সবার প্রতি আমার অনুরোধ যে যেভাবে ১৯৭১ প্রত্যক্ষ করেছেন সেই বিষয়টুকু তুলে ধরুন। এর মাধ্যমে উঠে আসবে সঠিক ইতিহাস।
একাত্তর নিয়ে শুরু করার পূর্বে আমাকে ফিরে যেতে হবে ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালে। আমি কিন্তু এই অধ্যায়ে সমগ্র দেশের কথা বলছিনা আমার নিজ এলাকা আশপাশ ও গণমাধ্যমের বদৌলতে যা জেনেছি, নিজে প্রত্যক্ষ করেছি সেই সব নিয়ে আলোচনা করব। আমার লিখার বিষয় আমার নিজ এলাকা ও বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের আংশিক এবং সমগ্র বাংলাদেশের খন্ড চিত্র।
১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ও এগার দফা আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। শহর থেকে শুরু করে গ্রামে গঞ্জে ৬দফা ও ১১ দফার সমর্থনে আলোচনা সমালোচনা মিছিল মিটিং দেখা যেত। তখনকার সময়ে আজকের মত যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিলনা। শহর থেকে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দল বেঁধে গ্রামে আসতেন গ্রামাঞ্চলের মানুষদের সচেতন করতে। এই আন্দোলনে ভীত নড়ে যায় শামরিক শাসক আইয়ুব খানের ক্ষমতায় আসেন আরেক শাসক ইয়াহিয়া খান। তখন দেশের সর্বত্র্র শ্লোগান শুনা যেত “জেলের তালা ভাঙ্গবো শেখ মুজিবকে আনবো”। “ছয় দফা ১১দফা মানতে হবে মানতে হবে।” “আইয়ব মোনায়েম ভাই ভাই একরশিতে ফাঁসি চাই।” ঠিক এই সময় গ্রামে গঞ্জে দেশের অনেক স্থানে আইয়ব খান সমর্থিত চেয়ারম্যানদের বাড়ীঘর ভেঙ্গে দেয় ছাত্ররা। আমাদের এলাকায়ও বর্তমান তিন-নং সাবেক-২নং ইনাতগঞ্জ ই্উনিয়ের চেয়ারম্যান সাওমিয়া চৌধুরীর মোস্তফাপুর গ্রামে বাড়ী গুড়িয়ে দেয় ছাত্ররা। আমাদের এলাকার তৎকালীন কলেজ ছাত্র বনকাদিপুরের মনর উদ্দিন প্রতিদিন গ্রামের বাজারে লাউড স্পীকার নিয়ে ছয়দফার পক্ষে প্রচার করতেন। আমরাও প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র মাঝে মধ্যে বড়দের সাথে মিছিলে যেতাম।
তখন সাড়া বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মানতো। তিনি যা বলতেন তাই হতো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হয়ে উঠেন হ্যামিলনের বংশী বাদক। কারাগার থেকে মুক্তিপান বঙ্গবন্ধু, আসলো ১৯৭০ এর সাধারন নির্চাবন। ১৯৭০এর নির্বাচনে একক সংখ্যা গরিষ্টতা লাভ করে আওয়ামীলীগ। পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে চট্রগ্রামের রাজা ত্রিবিদ রায় চাকমা স্বতন্ত্র এবং ময়মনসিংহের নূরুল আমিন পিডিপি থেকে নির্বাচিত হন। এছাড়া সকল সিটে আওয়ামীলীগ পাশ করে। প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে আমার এলাকা নবীগঞ্জ থেকে হাতী প্রতিক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল আজিজ চৌধুরী ও দিরাই থেকে ন্যাপের প্রার্থী বাবু সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত বিজয়ী হন।
এছাড়া পূর্বপাকিস্তানে(বাংলাদেশে) প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আরো তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হন। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানেও আওয়ামীলীগ দুটি আসনে জয়লাভ করে। তখন আজকের মতো স্বাধীনতা বিরোধী জামাতে ইসলাম এতটা শক্তিশালী ছিলনা। প্রতিটি আসনে আওয়ামীলগের বিপরিতে মুসলিমলীগ, পিডিপি ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রর্থীরা প্রতিদন্দিতা করে। যুদ্ধ শুরু হলে দলগত ভাবে জামাতে ইসলাম, মুসলিমলীগ, নেজামে ইসলাম ও পিডিপি পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। দলগত ভাবে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম পকিস্তানের পক্ষ না নিলেও যারা আওয়ামীলগের বিরোধীতা করেছিল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও তার সমর্থকরা বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে পাকিস্তানের পক্ষ নেয় এবং গণহত্যায় পাকবাহিনীকে সহায়তা করে। তাদের অন্যতম ছিল বালাগঞ্জের মুফতি নূরউদ্দিন। এই নূর উদ্দিন জেনারেল ওসমানীর সাথে নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিল। তার নেতৃত্বে তার গহরপুর কৌমি মাদ্রসা থেকে তৈরী হয় কয়েক হাজার রাজাকার সদস্য। শ্রীরামসী গণহতা সহ বৃহত্তর সিলেটর প্রতিটি গণহত্যায় গহরপুর মাদ্রসার যেসব ছাত্ররা যারা রাজাককার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল তারা অংশ নেয়। আমি তখন ১৯৭০ এর ডিসেম্বরে ষষ্টশ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে গ্রামের বাড়ীতে এসেছি। তখন সমগ্র দেশে বইছে আনন্দের বন্যা। কখন বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্থান্তর করবে। পাকিস্তানীরা সামরিক শাসক টালবাহনা শুরু করলো আজ-কাল পরশু ইত্যদি।