অর্ধেক বিশ্ব থেকে উঠে গেছে প্রেম-ভালবাসা। প্রেম-ভালবাসা এখন বাজারের পণ্য। বৃটেনের বাজারে ভালবাসা এখন বিক্রি হয়। কোন জরিপ ছাড়াই অনায়াসে এমন আরো অনেক দেশের নাম বলে দেয়া যায়। যেমন প্রথমেই আমেরিকা, ইউরোপের প্রায় সবক’টি দেশ, কেনাডা এবং চীন রাশাও বাদ যায় না। তা’হলে আর বাকী থাকে কারা? বাকী সে সব দেশ গুলোর মধ্যেও প্রবেশ করেছে ভালবাসা ব্যবসা এবং হাটি হাটি পা-পা করে চলছে। এ কথাগুলো থেকে অনেকেই হয়তো অবাক হচ্ছেন এই ভেবে যে, পাগলের প্রলাপ না-কি? এগুলো কোন কথা হয়! প্রেম-ভালবাসা উঠে যাচ্ছে এবং অনেক দেশে উঠেই গেছে। অনেকেই হয়তো মুখ টিপে হাসছেন আর ভাবছেন, নিশ্চয়ই বেচারা ভালবাসায় গুঁতু খেয়ে রাগের মাথায় যা মুখে আসছে তাই বলছে। পাগলটা বুঝতে পারছে না যে প্রেম আর ভালবাসা স্বর্গীয়। এ দু’টি শব্দের স্থান মানব মনের অজানা আদেখা গহীনে। সন্তানের প্রতি মাথা-পিতার স্নেহ-মায়া-মমতা যেখান থেকে আসে সে স্থানের খোঁজ আজও মানুষের অজানা। আর অজানা বলেই মানুষ সে স্থানকে স্বর্গ(আরবরা বলে বেহেস্ত) শব্দ দিয়ে প্রকাশ করে থাকে। মানব মনের সে অজানা স্বর্গে অবস্থান করে মানুষের মনের সকল প্রেম-প্রীতি আর ভালবাসা। মনের এই ভাব প্রথমতঃ তৈরী হয়, সহজ সরল কথায় রক্তের এক অজ্ঞাত টানে; আর তৈরী হয় দীর্ঘ সময়ের চেনাজানা ও মন দেয়া-নেয়া থেকে। এই সহজ কথাগুলো বলতে আধুনিক কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ থাকতে হয় না। যেকোন সুস্থ মানুষই তা বলতে পারে। আর এ লোক এ সব কি বলছে! ছোট্ট একটি উদাহরণ দিয়েই যাচাই করা যেতে পারে বিষয়টির সত্যাসত্য। বৃটেনের ‘ডেটিং’ প্রথা বা ব্যবসার কথাই বলছি। প্রথা বলি কেনো, স্বয়ং বৃটিশ সমাজই এ অবস্থাকে শিল্প বা ‘ইণ্ডাষ্ট্রি’ বলে থাকে। বিশ্বাসের জন্য একটি দামী গবেষণা পত্রের নাম দিয়ে দু’লাইন তুলে দেয়া হলো- “Seeking Love in Modern Britain: Gender, Dating and the Rise of ‘the Single'” কেমন শুনায়! এখান বলা হয়েছে যে আধুনিক বৃটিশ সমাজে ভালবাসা খোঁজে নেয়ার ‘ডেটিং ইণ্ডাষ্ট্রি”র তালিকায় একা একা বসবাসকারীদের যে উত্থান ঘটেছে সে হিসেব থেকেই এসকল নর-নারীকে ভালবাসা সেবা দানের বিষয়টি লাফিয়ে লাফিয়ে উপরের দিকে উঠছে। এতে স্পষ্টতঃই বুঝা যায় একটি অকল্পনীয় পরিবর্তন এসেছে যৌণ আচরণে এবং সমাজ বিবর্তনে। একাকী বসবাস বা জীবনযাপন এখন একটি পরিচিত জীবনাচরণ পদ্বতি হয়ে উঠেছে। ‘ডেটিং ইণ্ডাস্ট্রি’র ওই হিসেব থেকে দেখা যায় হাটি হাটি পা পা করে এমন ভালবাসা সেবাদানের ব্যবসা শুরু হয়েছিল ১৯৭০ থেকে এবং বিশ বছরের মাথায় ১৯৯০ সালের দিকে এই একাকী জীবনযাপন বৃটিশ সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনের মূল ধারায় গিয়ে দাঁড়ায় যা এখন বৃটেনের মানব জীবনচক্রের রোমাঞ্চকর গ্রহনযোগ্য অংশ। বিবাহিত ছাড়া একাকী জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার চিন্তা যদিও নতুন কিছু নয় অতীব প্রাচীন। তবে সেগুলো খুবই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। লাখে এক কি-না সঠিক জানা নেই। আবার একজন নারী ও একজন পুরুষকে সারা জীবনের জন্য মিলিয়ে দেয়ার এ বিবাহ পদ্বতিও অনেক অনেক প্রাচীন। একসময় আনন্দবাজার লিখেছিল- ‘বিবাহ হল একটি সামাজিক বন্ধন বা বৈধ চুক্তি, যার মাধ্যমে দু’জন মানুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বিভিন্ন দেশে সংস্কৃতিভেদে বিবাহের সংজ্ঞার তারতম্য থাকলেও সাধারণ ভাবে বিবাহ এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে দু’জন মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ও যৌন সম্পর্ক সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে। কিছু সংস্কৃতিতে, যে কোনও প্রকারের যৌন কর্মকাণ্ডে প্রবৃত্ত হওয়ার পূর্বে বিবাহ সম্পন্ন করাকে বাধ্যতামূলক হিসেবে পরামর্শ দেওয়া হয় অথবা বিবেচনা করা হয়। বিবাহ সাধারণত কোনও রাষ্ট্র, সংস্থা, ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ, আদিবাসী গোষ্ঠী, কোনও স্থানীয় সম্প্রদায় অথবা দলগত ব্যক্তিবর্গের দ্বারা স্বীকৃত হতে পারে। একে প্রায়শই একটি চুক্তি হিসেবে দেখা হয়। বিবাহ মূলত একটি ধর্মীয় রীতি হলেও আধুনিক সভ্যতায় এটি একটি আইনি প্রথাও বটে।’ অন্তর্জাল ঘেঁটে দেখা যায়, দ্বাদশ শতাব্দীতে বল্লাল সেন প্রবর্তিত কৌলীন্যপ্রথা ধীরে ধীরে তার ধর্মীয় লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে এক ধরনের বিবাহ-ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছিল। হিন্দুধর্মীয় কুলীন পুরুষের বহু স্ত্রী রাখার ব্যবস্থা ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে এবং উনবিংশ শতাব্দীর সূচনায় এই প্রথা ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধির আকার ধারণ করেছিল। উনিশ শতকে কুলীন ব্যবসায়ীরা বিবাহের জন্য এককালীন পণ এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন উপলক্ষে অর্থলাভের আশা করতেন। ‘কুলমর্যাদা’ অর্থাৎ কিঞ্চিৎ অর্থগ্রহণ না করে এঁরা শ্বশুরবাড়িতে গমন করে উপবেশন, স্নান ও আহার কিছুই করতেন না, এমনকি স্ত্রীর সঙ্গে আলাপও করতেন না। দীর্ঘদিন পরে কুলীন জামাতা বেড়াতে এলে শ্বশুরশাশুড়ি এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজন তাই তাকে খুশী করার জন্যে সাধ্যমতো চেষ্টা করতেন। এমনকি অনেকে রাতে শোবার আগে শুভ সাক্ষাত উপলক্ষে জামাতা স্ত্রীর নিকট অর্থ দাবী করতেন। অতএব দেখা যাচ্ছে বিবাহ নিয়ে ব্যবসা খুব একটা নতুন কিছু নয়। অবশ্য মানুষ সকলে একই মন ও মতের হয় না কোন কালেই। মানুষের মধ্যে মতের ভিন্নতা থাকাটাও অতীব আদিম একটি বিষয়। কিন্তু সবকিছুর পরেও যে কথাটি বলা প্রয়োজন তা হলো মানুষ তার জাগতিক জীবনে সবপ্রাপ্তির উপরে স্থান দেয় ‘শান্তি’কে। জীবন যাপনে শান্তিই হলো মানুষের মূল কাম্য। অমোঘ সে শান্তির খোঁজেই মানুষ একে অপরকে খোঁজে বেড়ায় অনাদি অনন্তকাল থেকে। নারী খোঁজে নর আর নর খোঁজে নারীকে। দ্রুহিকবি নজরুলতো একেবারে খোলাসা করে দিয়ে নারীকে শান্তির দেবী “…জ্ঞানের লক্ষ্ণী, গানের লক্ষ্ণী, শস্য-লক্ষ্ণী নারী, সুষমা-লক্ষ্ণী…” উল্লেখ করে বলেছেন- মানব মনে শান্তির এই যে আকুতি তা তো অর্থের বিনিময়ে ব্যবসার সেবা দিয়ে অর্জন হয় না। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বে, বিশ্ব সম্পদ লুন্ঠনের তাগিদে নারীকে পণ্য বানিয়ে ব্যবহার করে প্রেম-ভাব-ভালবাসার নামে এমন ব্যবসাই শুরু করা হয়েছে। আর সে ব্যবসায় নীতি নৈতিকতার কোন স্থান নেই। সারা বিশ্ব খোঁজে দেখলেও ওই একই সূত্রের কাটা দাগ পাওয়া যাবে। |