হারুনূর রশীদ
তার উদ্দেশ্য ছিল এবং তিনি ধরে নিয়েছিলেন এটি সম্ভব। কিন্তু বৃটেনের ভোটাররা এমনভাবে তাকে বিমুখ করবে তা তিনিতো নয়ই, তাদের ‘থিঙ্ক ট্যাংক’রা বা অন্য কেউও ভাবতে পারেননি। তাই খুব চালাকি করে চারভাগের তিনভাগ সময় হাতে থাকতেই জাতীয় সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন এইতো সময়, দলের ভেতরে নেতা জেরেমি করবিনকে নিয়ে শ্রমিক দলীয় সুবিধাবাদীরা হট্টগোল করছে। এ অবস্থায় একটি নির্বাচন দিয়ে দিলে করবিন কোন দিক সামলাবে! দলের ভেতর না নির্বাচন। জিততো আমাদের হবেই বরং আরো কিছু আসন বেশী পেয়ে যেতে পারি। আর তখনই যে কোন সিদ্ধান্ত এককভাবে নেয়া যাবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি ঢেলে দিয়েছে করবিনের শ্রমিক দলের সাথে মিলে বৃটেনের রাজনীতি সচেতন সাধারণ মানুষ। বলতে গেলে একেবারে ন্যাড়া বানিয়ে দিয়েছে! বেশী পাওয়া তো হয়নি বরং এমন সংখ্যায় আসন খুইয়েছেন যে এখন অন্য কোন দল বা গোষ্ঠীর কাছে হাত পাততে হবে সরকার গঠন করতে চাইলে। ভারত বাংলাদেশের মত জোট সরকার গঠন করতে হবে।
ওই যে বাংলায় একটি প্রবাদ আছে না, ‘অতি লোভে তাঁতী নষ্ট’ আর ‘অতি চালাকের গলায় দড়ি’। রক্ষণশীল দলের নেতা জবরদস্ত রাজনীতিক তেরেশা মে-র অবস্থাও হয়েছে অনেকটা তাই। যা হয়েছে তাতে বলতেই হয় তিনি হেরে গিয়েছেন সাধারণ মানুষের নেতা করবিনের কাছে।
বিশ্ব গণতন্ত্রের সূতিকাগার বৃটেন রাজনীতির গণতন্ত্রের অনুশীলন এখনও দুনিয়াব্যাপী সমাদৃত। সেদিক থেকে, তেরেশা মে-র ন্যায় ভিত্তিক পদক্ষেপ হওয়া উচিৎ হবে, পদ থেকে সরে দাঁড়ানো। এতে তাঁর নিজের ব্যক্তিত্ব যেমন অটুট থাকে সাথে সাথে বৃটেনের শত শত বরষের গণতন্ত্র চর্চ্চার ঐতিহ্য সমুজ্জল থাকে।
তেরেশা মে পদত্যাগ করবেন না ইতিমধ্যেই বলেদিয়েছেন। কারণ ওই যে রাজনৈতিক চরিত্র। দুনিয়ার রাজনীতির ইতিহাস বলে, ছল-চাতুরির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনকারীরাই মোটা দাগে রক্ষণশীল হয় আর রক্ষনশীলরাই ছল-চাতুরির চারিত্রিক কারণে প্রতিক্রিয়াশীল থাকে। সাধারণ মানুষের কল্যাণ চিন্তার আগে তাদের কাছে অগ্রাধিকারে থাকে নিজেদের স্বার্থচিন্তা। আরো খাঁটী কথায় বললে মুনাফার হিসেব।
রক্ষণশীলরা ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’ বা কল্যাণ রাষ্ট্র আর দেখতে চান না। তারা রাষ্ট্রের কল্যাণ বলতে তাদের কল্যাণই মনে করেন। তাইতো বৃহৎ ব্যবসার তারা উমেদারি করেন। সেই কবে, তাদের তৈরী আদর্শ রাষ্ট্র নায়ক যাকে তারা কাগুজে বাঘ বানিয়েছিলেন ‘আয়রণ লেডি’ আখ্যায়িত করে, প্রয়াত সেই মার্গারেট থেসার ছোট ছোট ব্যবসার বারোটা বাজিয়ে বড় বড় কোম্পানীকে বাজার দখলের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সেই থেকে কল্যাণ রাষ্ট্র ভেঙ্গে দেয়ার তাদের কাজ শুরু হয়েছিল যা আজও অব্যাহত রয়েছে সমানতালে। তারা এনএইচএস-কে একেবারে আমেরিকার মত বেসরকারী করে দিতে চান। রেলের যাত্রীসেবাকেও তারা ব্যক্তিমালিকানাধীন করে নিতে চান। স্কুলে সকল শিশু-কিশোরদের ‘টিফিন’ বন্ধ করে দিতে চান। কলেজের ফিস ৩হাজার থেকে দফায় দফায় বাড়িয়ে এখন ৯হাজারে তুলেছেন। দেশের স্বাস্থ্য সেবাকে ঢেলে সাজানোর নামে ভেঙ্গে দেয়ার বিষয়ে যিনি শরিক হয়ে বই লিখেছেন রক্ষণশীলদের সেই কীর্তিমান জেরেমি হান্টকে স্বাস্থ্য মন্ত্রী বানানোর মধ্য দিয়েই তাদের আসল চিন্তার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়।
ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন থেকে বৃটেনের বের হয়ে যাবার আনুষ্ঠানিক কথাবার্তা ১৯ জুন থেকে শুরু হবার কথা ছিল। এখন সে আলাপ আলোচনা কি শুরু করা যাবে? সরকার গঠন না করা পর্যন্ত সে আলাপে যাওয়া সম্ভব নয় বলেই অভিজ্ঞজন মনে করছেন। ইতিমধ্যেই ‘ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন বাজেট কমিশনার’ গান্থার ওয়েটিংজার এমন প্রশ্ন তুলেছেন যে আগের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন থেকে বৃটেনের বের হয়ে যাবার কথাবার্তা ১৯ জুন থেকে শুরু হবে কি-না! সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা খবর, গান্থার সংবাদ মাধ্যমে আরো বলেছেন যে সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত কোন আলাপই হতে পারে না!
সুইডেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কার্ল বিল্দথ, আরেক রক্ষণশীল যিনি বর্তমানে ‘ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের বৈদেশিক সম্পর্কে’র “থিঙ্কট্যাঙ্ক” বৈঠকের সভাপতি তার টুইটে বলেছেন ‘লেক অব ট্রু লিডারশীপ’ এ ফলাফল একটি জঞ্জাল।
সব শিয়ালের এক রা! ভোট হয়েছে, সাধারণ মানুষ ভোট দিয়েছে। কিন্তু যেহেতু ফলাফল রক্ষণশীলদের পক্ষে যায়নি সুতরাং নেতৃত্বের অভাব আর জঞ্জাল মনে হয়েছে তার কাছে। ওই যে তার শ্রেণী চরিত্র। তিনি ভাল করেই জানেন বৃটেনের নির্বাচনের দিকে দুনিয়া চেয়ে থাকে। এখনও দুনিয়ায় সত্যিকার অর্থে নির্বাচন বলতে, মানুষ বৃটেনের নির্বাচনকেই দেখে থাকে। আর তিনি কি-না টুইট করে বলে দিলেন এটির ফলাফল তার কাছে জঞ্জাল। ভোট দিয়ে মানুষ নিজের মতামত ব্যক্ত করে। এই মতামত ব্যক্ত করার ফলাফলকে একজন মানুষ কখন জঞ্জাল মনে করতে পারে? গণতান্ত্রিক বিধান মতে সাধারণ মানুষের মতামতের উপর যার কোন আস্তা নেই একমাত্র সে লোকই এমন মন্তব্য করতে পারে। ফলাফলে জঞ্জাল তৈরী হবার জন্য তো ভোট নয়। তা তিনি ভাল করেই বুঝেন। এই হলো রক্ষণশীল ‘থিঙ্কট্যাঙ্ক’!
যদিও কট্টর রক্ষণশীল নন এমন আরেকজন ‘ব্রেকজিট মধ্যস্থতাকারী’ যিনি ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টে “এলায়েন্স অব লিবারেলস এন্ড ডেমোক্রেটস ইন ইউরোপ” এর সভাপতি খুব তিক্ত কথা দিয়ে তেরেশা মে’কে আক্রমণ করেছেন। বলেছেন, ক্যামেরুন নিজের বিপক্ষে গোল করেছিল এবার মে আরেকটি গোল করলেন। অর্থাৎ তিনি বুঝাতে চেয়েছেন ক্যামেরন গণভোট দিয়ে একটি ভুল করেছিল আর জাতীয় ভোট দিয়ে তেরেশা আরেকটি ভুল করলেন।
লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো এসব আলোচনা আর কটাক্ষ সবকিছুর মূলে রক্ষণশীলরা ভোটে এককভাবে পাশ করতে পারেনি, তাই!
স্কটল্যান্ড ভিত্তিক এসএনপি নেতা নিকলা ষ্টারজিওন, রক্ষণশীলদের সরকারের বাইরে রাখার উদ্দেশ্যে অন্যান্যদের সাথে কাজ করতে রাজী আছেন জানালেও অবশেষে ডিইউপি-দের নিয়েই সরকার গঠন করবেন বলে তেরেশা মে নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন।
করবিন বলেছেন তেরেশা মে’র সরে যাওয়া যুক্তিযুক্ত। তা’হলেই শ্রমিক দল ‘মাইনরিটি সরকার’ গঠনের উদ্যোগ নিতে পারবে। সবকিছু মিলিয়ে বলা যায় সরকার গঠন করলেও রক্ষণশীলদের হার হয়েছে এটাই ঠিক। দেখার বিষয় ব্রেক্জিট পর্বে কি হয়।