মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলায় মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নির্মাণে চরম অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ঘর নির্মাণে ব্যবহার হয়েছে নিম্নমানের সামগ্রী। অনুসরণ করা হয়নি নির্ধারিত নক্সা। উপকারভোগীরা ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরের টাকায় আর্থিক লাভমান হয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের কর্মচারীবৃন্দ। এদিকে রাজনগর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের অফিস সহকারী সুমন ও অফিস সহায়ক বিপ্লব রায়ের বিরুদ্ধে বিগত ১৪ নভেম্বর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন উপজেলার টেংরা ইউনিয়নের মো: মন্নান খান নামের এক ব্যক্তি।
জানা যায়, রাজনগরে এ পর্যন্ত মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ৩৬৩টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। চতুর্থ পর্যায়ের প্রথম ধাপে ৭০টি এবং দ্বিতীয় ধাপে ৭৭টি ঘর নির্মাণ করা হয়। প্রতিটি ঘরের ব্যয় ধরা হয়েছে দুই লক্ষ চৌরাশি হাজার পাঁচশত টাকা। এর সাথে পরিবহণ ও জ্বালানি খাতেও অতিরিক্ত বরাদ্দ ছিল।
ঘর বাস্তবানের জন্য উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ছিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সদস্য সচিব প্রকল্প বাস্তাবায়ন কর্মকর্তা ও সদস্য ছিলেন সহাকারী কমিশনার(ভুমি), উপজেলা প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান। এ কমিটির নিয়মিত সভা করে কার্যবিবরণী করার কথা থাকলেও কিছুই করেননি দায়িত্বরতরা। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারজানা আক্তার মিতা ও অফিস সহকারী সুমন সিন্ডিকেট নামকাওয়াস্তে কাজ করে বিয়ারার চেকের মাধ্যমে নামে বেনামে টাকা উত্তোলন করে চতুর্থ পর্যায়ের ১৪৭টি ঘর থেকে বড় অংকের টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে। ইতিমধ্যে নানা অভিযোগে রাজনগর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলীকে বদলি করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
বাস্তবে দেখতে উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের আব্দুল্লাহপুর গ্রামে গেলে দেখা যায়, ৪৭টি ঘরে ইট ছাড়া মেঝে ঢালাই দেয়া হয়েছে। দেয়ালে দিয়েছে ফাঁটল, বাথরুমের কমেট ভেঁঙ্গে গেছে ও ছোট আকারের কাঠ লাগানো হয়েছে। ২৫০ মিটার গাইড ওয়াল নির্মাণ করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। মেঝে ভেঁঙ্গে পূণরায় কাজ করানো হচ্ছে উপকারভোগীদের দিয়ে। এসময় ঘরের উপকাভোগী সন্ধা রাণী ও তার স্বামী গৌরাঙ্গ বলেন, ঘরের কাজ সঠিক হয়নি। ঘরে উঠার আগেই আস্তর ও দেয়াল ফেঁটে গেছে। আকিল মিয়া, নেহার বেগম, খরকুন নেছা ও আব্দুল কাইয়ুম সহ উপকারভোগীরা বলেন, প্রথমে ইট ছাড়া ফ্লোর ঢালাই দেয়া হয়েছিল। যার কারণে ঘরে উঠার আগেই ফ্লোর ভেঁঙ্গে যায়। পরবর্তীতে আমাদের দিয়ে ফ্লোর ভেঁঙ্গে আবার কাজ করা হচ্ছে। ইট, বালু ও পানি বহনের কাজও আমাদের দিয়ে করানো হয়।
উপজেলার কামারচাক ইউনিয়নের করাইয়া গ্রামে গেলে দেখা যায়, ইট ছাড়া ঘরের ফ্লোর ঢালাই দেয়া হয়েছে। বাথরুমের কমেট ভাঁঙ্গা, ঘরের উপরে ব্যবহত কাঠ নিম্নমানের, আকারেও ছোট। ফেঁটে গেছে দেয়াল ও বারান্দা। ভেঁঙ্গে গেছে ফ্লোর। অনেকে নিজ উদ্যোগে মেরামত করেছেন ফেঁটে যাওয়া ও ভাঁঙ্গা স্থান। বন্ধ রয়েছে ৩টি টিউবওয়েল। ফলে বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এসময় উপকারভোগীর মধ্যে দুলবি বেগম, মৌলা মিয়া, কালাম মিয়া, আব্দুল মতিন, আফিয়া বেগম, মনির মিয়া ও সুমনা আক্তারসহ অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের কষ্ট লাগবের জন্য ঘর দিয়েছেন। ঘর পেয়ে আমরা অনেক খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু ঘরে এসে দেখি নিম্নমানের কাজ হয়েছে। কেউ নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবেনা।
বৃষ্টির দিন ঘরের ভেতরে পানি ডুকে যায়। বেশি ঝড় তুফানের সময় ঘরের চাল উড়ে নিয়ে যাওয়ার আতংঙ্কে থাকি। প্রতিটি ঘরের বাথরুম ভাঁঙ্গা ও দূরগন্ধ বের হয়। এভাবে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছি। প্রধানমন্ত্রীর ঘরের টাকায় আমাদের চেঁয়ে বেশি উপকার হয়েছে যারা ঘরে কাজ করেছেন তাদের। কাজ চলাকালিন সময়ে অনিয়ম দেখে ঠিকাদার ফজলুকে বাদ দিলে সে বলে, বেশি কথা বললে ঘরে থাকতে পারবেন না। তোমাদের ঘর দেয়া হবে না। করাইয়া গ্রামে গাইড ওয়াল নির্মাণেও চরম অনিয়ম হয়েছে। একই অবস্থা উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়নের মধুর দোকানের ২১টি ঘরেও।
ঠিকাদার ফজলু মিয়া বলেন, “সুমন স্যারের মাধ্যমে কাজ করেছি। উনি যেভাবে বলেছেন, সেভাবে করেছি। শ্রমিকদের মজুরি সুমন স্যারের কাছ থেকে নগদ এনেছি। চেকের মাধ্যমে কোনো টাকা পাইনি।
রাজনগর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের অফিস সহকারী সুমন আহমদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর বাস্তবায়ন আমার দায়িত্ব নয়। কর্তৃপক্ষ আমাকে কোথাও পাঠালে আমি দেখভাল করি। অনিয়মের সাথে আমি সম্পৃক্ত নই। কাজের লোকদের মাঝে মধ্যে নগদ টাকা দিয়েছি। অধিকাংশ টাকা চেকে পরিশোধ করেছি। অভিযোগ রয়েছে অধিকাংশ ‘বেয়ারার চেকে’ আপনি টাকা উত্তোলন করেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাঝে মধ্যে বেয়ারা চেকে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
তৎক্ষালিন উপজেলা প্রকৌশলী আকরাম হোসেন বলেন, ইউএনও এবং এসিল্যান্ড স্যারের সাথে মাঝে মধ্যে সাইট ভিজিটে গিয়েছি। আমি যেখানে গিয়েছি সেই ঘর গুলো দেখেছি ঠিক আছে। কিন্তু সব ঘর দেখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
সদ্য বিদায়ী রাজনগর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী বলেন, ঘরের কাজ শুরুর দিকে নিম্নমানের সামগ্রীর ব্যবহার দেখে আমি নিষেধ করি এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিষয়টি অবগত করি। কিন্তু আমার নিষেধ আমলে না নিয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অফিস সহকারী সুমনের মাধ্যমে নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে কাজ করান। এজন্য আমি দায়ি নই।
রাজনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা আক্তার মিতা বলেন, আপনি যেভাবে দেখেছেন আমিও পরিদর্শনে গেলে ত্রæটি দেখি। সাথে সাথে ত্রæটি সমাধানের জন্য পিআইও সাহেবকে লিখিতভাবে অবগত করি। বালু মাটিতে ভরাট করায় ঘরের ফ্লোর সামান্য ফেঁটে যাওয়ায় ভেঁঙ্গে পূণরায় করা হচ্ছে। কাজ এখনও চলমান। টাকাতো ক্রস চেকে পরিশোধ করার কথা কিন্তু আপনি দিয়েছেন বেয়ারা চেকে। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ক্রস চেকের কথা আমাকে বলেনি এবং আমার জানাও নেই”।
Comments are closed.
এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা কিভাবে হবে পরবর্তী তে শেখ হাসিনার স্মার্ট বাঙলাদেশ কিভাবে হবে।Grass root level থেকে দূর্নীতি আর অনিয়মে সড়ক আর সরকারি স্থাপনা নির্মাণে আসল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হয় না। এসব থেকে আমাদের পরিত্রাণের উপায় কি। রক্ষক যেখানে ভক্ষক, তাতে সরকারের ই কি করনীয় আছে। আজকের স্লোগান হবে, আসুন আমরা শিক্ষিত মানুষেরা সৎ হয়ে সৎকর্ম করি।