ঐতিহ্য পর্যটক এলিজা নির্মিত
সমাজসংস্কারক, নারীশিক্ষার অগ্রদূত ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নারীনেত্রী মহীয়সী নারী লীলাবতী নাগ(লীলাবতী রায়)কে নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র ‘লীলা নাগ: দ্য রেবেল’–এর প্রদর্শনী হয়ে গেল ৯ ডিসেম্বর শনিবার বিকাল ৩ ঘটিকায় মৌলভীবাজার জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে। আয়োজন করে লীলা নাগ স্মৃতি পরিষদ, মৌলভীবাজার।
মৌলভীবাজারের কৃতি সন্তান কিংবদন্তি আলোকবর্তিকা লীলা নাগ’কে নিয়ে নির্মিত ‘লীলাবতী নাগ: দ্য রেবেল’ তথ্যচিত্রটি এ আর এম নাসিরের পরিচালায় নির্মাণ করেন এলিজা বিনতে এলাহী এবং এলিজা বিনতে এলাহীর উপস্থাপনা ও পরিকল্পনায়।
লীলা নাগ স্মৃতি পরিষদের সভাপতি ও মৌলভীবাজার জেলা বারের সভাপতি এডভোকেট রমা কান্ত দাশ গুপ্তের সভাপতিত্বে, সাধারণ সম্পাদক এম, খসরু চৌধুরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা লেখক ও গবেষক ডা. আব্দুল আহাদ, লেখক এডভোকেট মুজিবুর রহমান মুজিব, মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ দেবাশীষ দেবনাথ, ডা. সত্যকাম চক্রবর্তী, সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ সালমা বেগম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(সার্বিক) প্রাভাংশু সোম মহান, মৌলানা মোফজ্জল হোসেন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ তোফায়েল আহমেদ, রাজনগর ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ রজত কান্তি গোস্বামী, সামাজিক ব্যক্তিত্ব সৌমিত্র দেব টিটু, সাংস্কৃতিক সংগঠক আ স ম সালেহ সোহেল প্রমূখ। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন শ্রেণী পেশার গণ্যামান্য ব্যক্তিত্ব ও লীলা নাগ স্মৃতি পরিষদের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন তথ্যচিত্রটির নির্মাতা এলিজা বিনতে এলাহী এবং পরিচালক এ আর এম নাসির।
প্রায় ৬০ মিনিটের এই তথ্যচিত্রে স্থান পেয়েছে লীলা নাগের সংস্পর্শে আসা বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক মানুষের বক্তব্য। অবিভক্ত বাংলায় লীলা নাগ যত জায়গায় বসবাস করেছেন, সেসব স্থান উঠে এসেছে এতে। সমাজসংস্কারে লীলা নাগের অবদান উঠে এসেছে তাঁদের কথায়।
তাঁর জীবনী পড়লে যে কারও রক্ত গরম হয়ে যাবে- দেরিতে হলেও এমন একজন মানুষকে নিয়ে প্রামাণ্য চিত্র ‘লীলাবতী নাগ: দ্য রেবেল’ নির্মিত হয়েছে, সেটা অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
লীলা নাগ শুধুই একজন মেধাবী ও বিদূষী নারী নয়, কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মেয়ে শিক্ষার্থীই নয়, তিনি ছিলেন এক জীবন উৎসর্গ করা বিপ্লবী যোদ্ধা।
সংগ্রাম, ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লব, নারী জাগরণে সংগঠন ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠা, নারীদের কর্মমুখী হয়ে ওঠায় তার অবদান উঠে এসেছে এলিজার বয়ানে। লীলাবতী নাগের গড়ে তোলা দীপালি সংঘ তৎকালীন ভারতবর্ষের অন্যতম শক্তিশালী একটি সংগঠন ছিল। স্বামী অনিল রায় ও লীলা নাগ মিলে প্রায় ১২টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। জয়শ্রী নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন লীলা নাগ, যা চালাতেন নারীরা। এই পত্রিকা ও প্রকাশনের নাম দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
নারী জাগরণ থেকে স্বদেশি আন্দোলন—ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশে লীলাবতী নাগের অবদান অনস্বীকার্য। অবিভক্ত বাংলায় নারীশিক্ষা ও নারীর অধিকারের মতো অনেক ক্ষেত্রেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। কিন্তু তাঁকে নিয়ে যেমন আলোচনা হয় না, তেমনি নেই স্মৃতি রক্ষার উদ্যোগ। লীলাবতী নাগের স্মৃতি রক্ষার গুরুত্ব উঠে এসেছে ‘লীলা নাগ: দ্য রেবেল’ তথ্যচিত্রটিতে।
লীলা নাগের যোগসূত্র- লীলা নাগের পিতৃভিটা মৌলভীবাজারের রাজনগরে অবস্থিত। ভিটা জবরদখল হয়ে গেলেও এখনও তার ধ্বংসাবশেষ রয়ে গেছে। এখনও সেখানে রয়ে গেছে প্রাগ্রসর চেতনার উত্তরাধিকার, কিছু অমূল্য স্মৃতি, যা কালের চক্রে স্বার্থান্বেষী মহলের হাতে পড়ে লুপ্ত হতে চলেছে।
‘লীলাবতী নাগ: দ্য রেবেল’ নির্মাতা এলিজা বিনতে এলাহী এক ঝুঁকিবহুল শখের পিছনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সারা পৃথিবী, তার মাঝেও প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণের মতো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি জানান, দেশের মহীয়সী নারীদের জীবন কাহিনি নিয়ে নির্মিত এটি তার পঞ্চম পর্ব।
তিনি পেশায় একজন শিক্ষক। নিজেকে ‘ঐতিহ্য পর্যটক’ হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। তিনি ইডেন মহিলা কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করেন। পরে এআইইউবি থেকে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থেকে এমবিএ করেন।
এমনকি নেদারল্যান্ডসের দি হেগ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সেসে কমিউনিকেশন ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধীনে বাংলাদেশের হেরিটেজ ট্যুরিজমের ওপর গবেষণা করেছেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বিকাশে হেরিটেজ ট্যুরিজমের গুরুত্ব’। দেশের ৬৪ জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো ঘুরে দেখছেন। এগুলোর তথ্য সংগ্রহের কাজ করছেন। দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়েই তার মূল ভাবনা।
১৯৭৬ সালের ৬এপ্রিল ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মরহুম এস এম এলাহী নেওয়াজ, মা সাবেক সংসদ সদস্য রহিমা খন্দকার। এলিজা পড়াশোনা করেছেন শহীদ বীর উত্তম লে. গার্লস কলেজ, লালমাটিয়া মহিলা মহাবিদ্যালয়, ইডেন মহিলা কলেজ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এবং নেদারল্যান্ডসের দি হেগ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সেজ-এ। শিক্ষকতার পাশাপাশি পর্যটক হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে।
‘লীলাবতী নাগ: দ্য রেবেল’ প্রদর্শিত হবে নিউ ইয়র্কে আগামী ফেব্রুয়ারি ২০২৪ এ। গত ৮ নভেম্বর ২০২৩ আগারগাঁও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে প্রদর্শিত হয় তথ্য চিত্রটি।