বিচারকদের অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে তিনজন অ্যামিকাসকিউরি আদালতে বক্তব্য রেখেছেন। শুনানিতে সিনিয়র আইনজীবী টিএইচ খান আদালতকে জিজ্ঞাসা করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করল কে? সরকার বলছে এটি আদালত বাতিল করেছে। কিন্তু আদালতের রায় প্রকাশের আগেই তো সংসদ সেটি বাতিল করে দেয়।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম বলেছেন, পৃথিবীর বহু দেশের সংসদ বিচারককে অপসারণের বিধান থেকে সরে আসছে। কোনো বিচারক ভুল করলে তার বিচার করার ক্ষমতা জুডিশিয়ারির হাতেই থাকা উচিত।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির অপর সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল না থাকলে দেশে অরাজকতা হবে। অন্যান্য বিভাগে কর্মরতদের অপসারণের ক্ষমতা তাদের নিজ বিভাগের হাতেই রয়েছে। বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা কেন অন্য বিভাগের হাতে থাকবে?
এদিকে শুনানির এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, এখন না হয় সংসদে নিরঙ্কুশ (দুই-তৃতীয়াংশ) সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। কিন্তু কোনো সময়ে যদি এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকে? যদি ‘হ্যাঙ্গিং পার্লামেন্ট’ হয়? তাহলে কি হবে? সে সময় যদি কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠে তখন তাকে কিভাবে অপসারণ করা হবে? তখন তো একটা শূন্যতা তৈরি হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাত বিচারকের বেঞ্চে এই শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানির শুরুতে সুপ্রিম কোর্টের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী টিএইচ খানের লিখিত অভিমত উপস্থাপন করেন তার ছেলে অ্যাডভোকেট আফজাল এইচ খান। এ সময় টিএইচ খান আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল না করার কোনো বিকল্প নেই। তবে, ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিষয়টি নিষ্পত্তি না করে ষোড়শ সংশোধনীর আলোচনা ঠিক হবে না। এই দুটিকে প্রাসঙ্গিকভাবে দেখতে হবে।
এই সরকার বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি তারা বাতিল করেনি। বাতিল করেছে আদালত। প্রকৃতপক্ষে ত্রয়োদশ সংশোধনী কি আদালত বাতিল করেছিল? সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক যখন এই রায়ে স্বাক্ষর করেছেন তখন তিনি সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক ছিলেন না, তার শপথও ছিল না। অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস আগে তিনি যখন সংক্ষিপ্ত আদেশ দিয়েছিলেন, সেখানে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দশম এবং একাদশ নির্বাচন হওয়া উচিত অভিমত দেন। কিন্তু অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পরে প্রকাশ্যে আদালতে ঘোষিত সংক্ষিপ্ত রায় তিনি বদলে ফেলেন। এই বদলে ফেলাটা বিধিবিধান মেনে হয়নি। একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক হিসেবে তিনি কিভাবে সংক্ষিপ্ত আদেশ বদলে ফেলেন?
টিএইচ খান বলেন, বিচারপতি খায়রুল হকের সমর্থনে অন্য যে দুজন বিচারপতি তাতে স্বাক্ষর করেছেন তারাও সঠিকভাবে এ কাজটি করেননি এবং তাদের ওই স্বাক্ষরটাও গ্রহণযোগ্য নয়। বিচারপতি আব্দুল ওয়াহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা এবং বিচারপতি ইমান আলী ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ আইন বলে রায় দিয়েছিলেন। এ কারণেই আমার প্রশ্ন ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করলো কে?
তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় প্রকাশ হয়েছে। রায় প্রকাশের আগেই সরকার পঞ্চদশ সংশোধনী করেছে। অথচ সরকার বলেছে, এটা আদালত বাতিল করেছে। ষোড়শ সংশোধনী যে সংসদ পাস করেছে সেটি বৈধ সংসদ ছিল না। ওই সংসদের গঠন এবং নির্বাচন প্রক্রিয়া কোনোটিই বৈধভাবে হয়নি।
৯৬ অনুচ্ছেদে ‘ইন ক্যাপাসিটি’ অথবা ‘গ্রস মিসকন্ডাক্ট’ এ দুটো বিষয় বলা আছে। কিন্তু আমরা দেখছি অনেক বিচারপতি শত শত মামলার রায় না লিখে অবসরে চলে যান। আদালতে বসে এমন বক্তব্য রাখেন যেগুলো গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের ব্যক্তিগত আচার-আচরণও নিয়ন্ত্রণ করা উচিত ছিল।
ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে যেসব আইন-কানুন রয়েছে, জাতিসংঘ থেকে শুরু করে ইউরোপ বা কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোতে যে সমস্ত রুলস দেখা যাচ্ছে, সব জায়গায় এখন জুডিশিয়ারি যে কম্পিটেন্স এবং তাদের যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট এবং তাদের যদি কোনো ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন প্রয়োজন হয় ওটা তারা নিজেরাই করবে—এ ধারণা প্রতিষ্ঠা লাভ করছে। বেশিরভাগ দেশই বিচারক অপসারণে সংসদের হাতে যে ক্ষমতা ছিল তা থেকে সরে এসেছে। তারা জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপরই দায়িত্ব দিচ্ছে। যদি কোনো বিচারক ভুল করেন তার বিচার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলই করবে। তিনি বলেন, সংসদের হাতে বিচারক অপসারণ পদ্ধতি কোনো দেশেই কার্যকর হতে পারছে না। সেখানে আরো বেশি বিতর্কের সৃষ্টি হচ্ছে এ নিয়ে। শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়াতেও বিচারক অপসারণ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হচ্ছে।
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেন, ৭২-এর সংবিধানে আমরা ওইভাবে জুডিশিয়ারি গড়ে তুলতে পারিনি। তখন আমাদের প্রধান বিচারপতি কে হবেন তা নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। বঙ্গবন্ধু ফেরার পর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আমরা প্রধান বিচারপতি খুঁজতে থাকি।
প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি সায়েমকে নিয়ে আসলাম। পরবর্তী সময় তিনি তো সামরিক শাসকের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন। সময়ের কারণে সে সময়ে আমরা জুডিশিয়ারি গড়তে পারিনি। ওই পরিস্থিতিতে আমরা অপসারণের বিষয়টি সংসদের হাতে রেখেছিলাম। কেননা তখন সংসদ ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠান সেভাবে গড়ে ওঠেনি।
ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ বিচারপতিদের নিয়ে সংসদে বিরূপ সমালোচনার প্রকাশিত প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করে বলেন, এক পত্রিকায় শিরোনাম দেখেছি—‘তোরে জজ বানাইছে কেডা’। যারা সংসদে দাঁড়িয়ে বিচারকদের নিয়ে এমন মন্তব্য করেন তাদের হাতে অপসারণের ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন? তখন কি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকবে? তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের নিয়ে সংসদে আলোচনার সুযোগ নেই। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিভিন্ন ইস্যুতে সংসদ সদস্যরা আলোচনা-সমালোচনা করেছেন। জাতীয় সংসদের স্পিকারকেও এ বিষয়ে বাধা দিতে দেখেনি। ব্যারিস্টার রোকন বলেন, এ কথা বলা যাবে না (বিচারপতিদের) ত্রুটি নেই, দোষ গুণ মিলিয়েই মানুষ।
ব্যারিস্টার রোকন বলেন, শিক্ষা-দীক্ষায়, দক্ষতা-যোগ্যতায় এবং সম্মানে আপনারা (বিচারকরা) কি কারো চেয়ে কম? ফলে অপসারণের ক্ষমতা তাদের হাতে থাকলে সম্মান ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকবে না। তিনি বলেন, ‘সিভিল সার্ভিসের ব্যক্তিদের কারা অপসারণ করে? পুলিশ বা সচিবালয়ে কারা করে? নিশ্চয়ই সংসদ নয়। শৃঙ্খলা বিধান সংক্রান্ত ক্ষমতা স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের হাতেই ন্যস্ত রয়েছে। সহকারী সচিবদের তদন্ত করে যুগ্ম সচিবরা। মিলিটারিদেরটা ডিসিপ্লিনারিও তাদের হাতে। তাহলে বিচারকদেরটা কেন সংসদের হাতে থাকবে?’ খবর ইত্তেফাকের।