২০১৯সালের ২রা জানুয়ারীতে চীনারা চাঁদে নেমেছে। চাঁদের যে প্রান্তে চীনের ওই মহাশূণ্যযান অবতরণ করেছে সেখানে আজ অবদি মানব সম্প্রদায়ের অন্য কেউ যাননি। চীনা মহাশূণ্য গবেষণা প্রকল্পের “চেঞ্জ’ই-৪” নামের এই মহাশূণ্যতরী গত ২০১৮ সালের ৭ই ডিসেম্বর আকাশ পথে রওয়ানা হয় এবং ১২ ডিসেম্বর মহাজগতের ভাসমান গ্রহ নক্ষত্রের কক্ষপথে শরিক হয়।
“চীনা ন্যাশনেল স্পেইচ এডমিনিষ্ট্রেশন” সংক্ষেপে সিএনএসএ-এর গোপনীয়তা সর্বজন বিদিত। চীন ছাড়া বাহিরের দুনিয়ার কেউই এর খবরাখবর রাখতে সক্ষম নন।
চীনাদের চাঁদের বিশেষ প্রান্তে অবতরণকে নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, চাঁদ এ পর্যন্ত ৪.৫ বিলিয়ন বছরেরও বেশী সময় ধরে পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করে আসছে। অনন্তবিশাল দীর্ঘ এই সময়ে পৃথিবীর আকর্ষণের টান চাঁদের কক্ষপথে ঘুরার গতিতে একটি সমলয়ের সৃষ্টি করেছে। ফলে, চাঁদ তার অক্ষরেখায়(কাল্পনিক রেখা) থেকে পৃথিবীকে ২৮দিনে একবার ঘুরতে পারে।
এতেকরে একটি বিষয় বুঝার যে আমরা মানুষেরা এ পৃথিবী থেকে চাঁদের একটি প্রান্ত কোনদিনই দেখতে পাইনা। যে প্রান্ত পৃথিবীর দিকে থেকে ঘুরে সে প্রান্তই আমরা ভূপৃষ্ট থেকে দেখতে পাই। বহু দূরের অন্যপ্রান্ত মানুষের অদেখাই রয়ে গেছে। পৃথিবীর মানুষ আমরা চাঁদের ওই প্রান্তকে চাঁদের অন্ধকার প্রান্ত বলেই জানি কিন্তু আসলে তা ভুল। চাঁদের যে প্রান্ত পৃথিবীর দিকে থেকে আবর্তিত হয় সে প্রান্ত হাজার কোটি বছর ধরে সূর্যের আলোয় স্নান করে যাচ্ছে। ভিন্ন প্রান্ত পৃথিবী থেকে দেখার কোন সুযোগই নেই। এপোলো নভোচারীরা যখন চাঁদের অদেখা প্রান্ত দিয়ে ঘুরে আসছিলেন তখন তাদের সাথে আমাদের পৃথিবীর সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
২০১৮সালের মে মাসে সিএনএসএ ‘কিউকিয়াও’ নামের একটি কৃত্তিম উপগ্রহ পাঠায় মহাশূণ্যের এমন একটি স্থানে যেখানে পৃথিবী ও চাঁদের আকর্ষণ কাজ করেনা। ওখান থেকে চাঁদের অন্ধকার প্রান্ত যেমন অবলোকন করা যায় একই সাথে পৃথিবীর প্রান্তও দেখার আওতায় রাখা যায়। এর পর থেকেই ‘কিউকিয়াও’ পৃথিবী ও চাঁদের অন্ধকার প্রান্তের খবরাখবর রাখছে নিয়মিত। এই কৃত্তিম উপগ্রহ, নতুন পাঠানো ‘চ্যাঞ্জ’ই-৪’ ও মিশন নিয়ন্ত্রণ ষ্টেশনের সাথে যোগাযোগে সহায়তা করবে।
‘চ্যাঞ্জ’ই-৪’ এর বিজ্ঞানীদল বাটি আকারের চাঁদের পুরোনো গর্ত নিয়ে অনুসন্দিৎসু। তারা এ গর্তের বয়স কত? এবং কেনো কিভাবে এ গর্ত সৃষ্টি হয়েছিল তা জানতে আগ্রহী। এ গর্ত পরীক্ষায় বেরিয়ে আসবে চাঁদ ও পৃথিবী তাদের জন্মের প্রাথমিক ইতিহাসে কত ধরনের সংঘর্ষ ও আঘাতের মুখোমুখী হয়েছিল। কত ধরনের বস্তু বৃষ্টির ধারার মত তাদের উপর নেমে এসেছিল! কখন কি নিয়ে এরা এসেছিল? প্রান বা জীবনের মূল কি ও কোথায় সে গবেষণায় এ ইতিহাস কাজে আসবে।
অনুসন্দিৎসু অনেকের মনেই একটি প্রশ্ন আসতে পারে, পৃথিবী থেকে গিয়ে সর্বপ্রথম চাঁদে পা রেখেছিল আমেরিকা। সেই আমেরিকা এমন মহাযজ্ঞের কাজ করতে গেলো না কেনো? কিংবা চীনাদের সাথে যৌথভাবে কাজ করতেও আমেরিকা নেই কেনো? উত্তর রয়েছে দু’টো। প্রথম উত্তর শক্তি। আর্থিক ও অস্ত্রগত শক্তি। এ উত্তরের প্রমান স্বরূপ কোন নথি নেই ঠিকই। তবে নথি না থাকলেও এটি একটি সঠিক উত্তর। পরাশক্তির খাতায় এখন চীনারা। পরাশক্তিধরদের নিজেদের মধ্যে কিছু অলিখিত শর্ত তৈরী হয়ে যায়। যে শর্তগুলোর পাহাড়া দেয় অস্ত্র আর অর্থ। পরাশক্তি হিসেবে চীনারা সবার আগে বলেছে আমরা এ বিষয় নিয়ে দেখবো। শক্তিধরদের এ ঘোষণাটাই শর্ত হয়ে কাজ করে। অন্য শক্তিধর কেউই সেখানে যাবে না। জানে যে ওখানে নাকগলাতে গেলে পুরো মাথাটাই গলে যেতে পারে।
এর পরের শর্ত লিখিত হয়েছিল আমেরিকায় বহু আগে। সে শর্তের নাম “ওলফ এমেন্ডমেন্ট”। এই ‘ওল্ফ এমেন্ডমেন্ট’ ইউএস স্পেইচ এজেন্সিকে চীনাদের সাথে মহাকাশ গবেষণাধর্মি কোন কাজ করতে বাধা দেয়। আমেরিকান কংগ্রেস কিংবা আমেরিকার ‘ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন’এর অনুমোদন ছাড়া চীনারা হ্যাঁ বললেও, নাসা চীনাদের ওই কাজে গাটছড়া বাঁধতে পারবে না।
চীনা মহাশূণ্য গবেষণা প্রকল্প “চেঞ্জ’ই-৪”এর প্রয়োজনীয় সকল যন্ত্রপাতিই যে চীনাদের তৈরী তা কিন্তু নয়। কিছু জার্মান গবেষক মহাকাশযানে ‘পাটিকুল ডিটেক্টর’ স্থাপন করে দিয়েছে। সুইডিশ গবেষকগন দিয়েছেন ‘আইওএন ডিটেক্টর’। মহাকাশযানের রেডিও টেলিস্কোপ যন্ত্রপাতি চীনা-ওলন্দাজ যৌথ ব্যবস্থাপনায় তৈরী।
চীনাদের এ আকাশ গবেষণা আমাদের জানাতে পারবে মহাবিশ্বে প্রথম তারাটি জন্মের ঠিক পূর্বে পৃথিবী, চাঁদ বা পুরো মহাজগৎ কি পর্যায়ে ছিল।