হারুনূর রশীদ।।
লণ্ডন।। সরকার ও বিরুধীদলের ঝগড়ার শেষ নেই। বলতে গেলে অনেকটা তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশের রাজনীতির মত হয়ে পড়ছে বৃটেনের রাজনীতি দিন দিন। অনেকটা বললে মনে হয় ভুল হবে। বলতে গেলে পুরো অবস্থাটাই এমনই দাড়িয়েছে যে বিরুধী শ্রমিকদল ভাল কিছু বললেও রক্ষণশীলগন তার বিরুদ্ধে তীব্রভাবে খুৎ খুঁজে বেড়ান। এ যেনো মহাভারতের রাম-রাবণের বাকযুদ্ধ। রক্ষণশীল সরকার পক্ষ, দেখে দেখে বেঁচে বেঁচে সুদীর্ঘকালব্যাপী শ্রমিকদলীয় সরকার যেসব সফল সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল সেগুলোকে কৃচ্ছ্বতার খোঁড়া যুক্তিদিয়ে ভেঙ্গে ফেলার মত পেছনদিকে হাটার পথ অনুসরণ করছেন। এখানের সমাজ ব্যবস্থায় রাজনীতি খুবই সুপ্রতিষ্ঠিত যেমন রক্ষণশীলদের জন্য তেমনি শ্রমিকদলের জন্যও। এখানের নাগরীক সমাজ ব্যবস্থার সকল অঙ্গে যে যেখানে আছে খুব জেনে-বুঝেই আছে।
আজও বিরুধী শ্রমিক দলীয় নেতা জেরেমী করবিন টুইট করে বলেছেন যে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি ১ হাজারের মত শিশু-কিশোরদের রক্ষনাবেক্ষনের কেন্দ্র যা “শিয়র স্টার্ট” নামেই খ্যাত , বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তিনি খুব সুন্দর কথায়ই লিখেছেন যে কৃচ্ছ্বতার নামে ধনবানদের উপর থেকে ট্যাক্স মওকুপ করে গরীব দুধমুখু শিশু-কিশোরদের একহাজার কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তার সাথে সুর মিলিয়ে কেমডেনের এমপি স্যার কেয়ার স্টারমার টুইট করে বলেছেন যে বাগাড়ম্বরপূর্ণ রাজনৈতিক বক্তৃতা দিয়েতো জীবন বদলানো যাবে না। কিন্তু “শিয়র স্টার্ট” সামাজিক বৈষম্যাবস্থার প্রতিকারে বাস্তবে শিশু-কিশোরদের জীবন বদলাতে সুযোগ করে দেয়। খুবই দুঃখ প্রকাশ করে সরকারের এই পদক্ষেপকে একটি অধঃপতনশীল পদক্ষেপ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন যে শ্রমিক দলের একটি প্রতিষ্ঠিত সফল ধারাবাহিক ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দেয়া হচ্ছে।
এখানে এই বৃটেনে বা দাপ্তরিক ভাষায় বলতে গেলে যুক্তরাজ্যে, শ্রমিক দল যখন ক্ষমতায় আসেন তখন মানুষের বিভিন্নধর্মী সেবায় আত্মনিয়োগ করে। শ্রমিকদল বিশ্বাস করে সকল মানুষের কল্যাণেই সরকার কাজ করবে। কতিপয় মানুষের সুখ কিংবা লাভের দিকে চেয়ে সরকার চলতে পারে না। তাই শ্রমিকদল ক্ষমতায় আসলে জাতীয় স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন ঘটে, উন্নয়ন ঘটে আইন-শৃঙ্ক্ষলা পরিস্থিতির। দেশের ছোট ছোট ব্যবসা প্রান ফিরে পায়। ফলে কাজের লোকের কাজ বাড়ে ও বেকারের সংখ্যা কমে আসে। রাস্তায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কমে যায় কারণ যুবক-যুবতী কিংবা কিশোর-কিশোরীদের অবসর সময় কাটানোর স্থানীয় ব্যবস্থার ব্যাপক আয়োজন করে সরকার। বিগত বছরগুলোতে শ্রমিকদল ক্ষমতায় থাকাকালীন সময় দেশে হাজার হাজার শিশু-কিশোর কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছিল, হাজার হাজার পুলিশ রাস্তায় টহল দিতে পারতো, সারা দেশব্যাপী ছোট ছোট ব্যবসা ও সেবাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার সুযোগ পেয়েছিল।
কিন্তু পরবর্তীতে রক্ষণশীলগন ক্ষমতায় আসার সাথে সাথেই শুরু হয় কৃচ্ছ্বতা সাধনের নামে বিভিন্ন খাতে অর্থ বরাদ্ধ কেটে দেয়া। এর পরই কোন এক অজ্ঞাত কারণে শুরু হয় অর্ধশত বছরের সাধনায় গড়ে তোলা ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার রাস্তা পরিষ্কার করার কর্মযজ্ঞ। সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী কেমেরুন তার কথা রক্ষার ভালমানুষি দেখাতে গিয়ে হঠাৎ করেই ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার জন্য গণভোট নামে এক প্রকারের হ্যাঁ-না ভোট দিয়ে বসেন। সাধারণ মানুষকে কোন কিছু বুঝতে না দিয়ে প্রচার করতে থাকেন ইউরোপীয়ান বিরুধী কথাবার্তা। কথায় আছে না, ‘রাজা বলে যত- পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ’এর মতই দেশের ধনীদের সংবাদ মাধ্যমগুলো হুমড়িখেয়ে ‘ব্রেক্সিট’ নাম দিয়ে প্রচার শুরু করে দেয়। ভোট হয়, অধিকাংশ মানুষ না বুঝেই ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার পক্ষে ভোট দেয়। রক্ষণশীলগন হাততালি দিয়ে ক্ষমতায় তাদের ভরাডুবি আটকায়।
এরপর আবার শুরুহয় হয় কৃচ্ছ্বতা সাধনের তাণ্ডবকীর্তন। সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায় এ পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার পুলিশকে চাকুরীচ্যুত করা হয়েছে। এতে করে গত এক বছরে কেবল লণ্ডন শহরে ৪৯জন নিহত হয়েছেন। চাকু অপরাধ শুধু সীমাহীন নয় ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে গিয়ে নাগরীক জীবনকে সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। অন্যদিকে এ পর্যন্ত দেড় হাজারের মত যুবক-যুবতীদের বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে এদের অবসরকালীন সময় কাটানোর আর কোন ব্যবস্থাই খোলা থাকলো না। এর ফল যে রক্ষণশীল সরকার বুঝেন না তাতো নয়। তারা এসব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজী নন। তাদের অঘোষিত কথা অযথা খরচের পাহাড় কমাতে হবে। সে যেভাবেই হোক। কৃচ্ছতার নামে খরচ কমাতে গিয়ে সাধারণ মানুষের এখন খাবার কমিয়ে আনার পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন একটাই, খরচ কমানোর নামে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেড় হয়ে আসা, বিভিন্ন সেবামূলক ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়া, সর্বোপরী জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার নাকাল অবস্থার পর একটি উন্নত দেশের আর কি থাকে উন্নত দাবী করার? এতোসবের পর প্রশ্ন কি আসতে পারে না যে আমরা আসলে কোন লক্ষ্যে হাটছি?