হারুনূর রশীদ।। বাংলায় প্রবাদ আছে- কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ। এতেই বুঝা যায় পৌষের শেষ মানেই সম্ভাবনা আর সমৃদ্ধির আবাহনী। সেই পৌষের আজ ছিল শেষ দিন। বাংলা দিনলিপিতে এই সময়টিই ক্রান্তি লগ্ন। আর পৌষ মাস বলে এটি পৌষ সংক্রান্তি। কালযাত্রার এ সময়টি আমাদের বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। শুধু বাঙ্গালী নয় প্রায় অর্ধেক বিশ্বের মানুষ এদিন আনন্দে আর উৎসবে মেতে উঠে পিঠাপুঠলির ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে। ভারত উপমহাদেশীয় পঞ্চাঙ্গ বা দিনলিপি(কেলেন্ডার) অনুযায়ী মলমাস অশুভ। আর এই দিনে সূর্য মকর রাশির ঘর থেকে বের হয়ে কুম্ভ রাশির ঘরের দিকে রওয়ানা দেয়। একে মলমাসের সমাপ্তি ধরা হয়। মকরের ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার কারণে বলা হয় “মকর সংক্রান্তি”। আবার মাস যেহেতু পৌষ তাই “পৌষ সংক্রান্তি”ও বলা হয়। পন্ডিতদের মতে এই দিন উত্তর দিক থেকে আসা সূর্যের আলোকে দিব্যশক্তি বলে মনে করা হয়। মনে করা হয় এই দিন শুভ শক্তির উত্থান হবে ও দক্ষিণ দিকে থাকা অশুভ শক্তিকে তা নাশ করবে।
এদিন পূর্ব ভারতে অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে পৌষ পার্বন আর বাংলাদেশে পৌষসংক্রান্তি সাকরাইন বা ঘুড়ি উৎসব পালিত হয়। বাংলাদেশে এসময় বিভিন্ন ধরনের খাবার এবং অন্যান্য উপহার ছাড়াও পৌষমেলার মাধ্যমে পৌষসংক্রান্তি উদযাপিত হয়। বাংলাদেশের মৌলভীবাজারের শেরপুরে বসে মাছের মেলা। বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সারা বাংলাদেশব্যাপী আর শহর-নগর-বন্দরে বসে বাউল গানের আসর।
ঘুড়ি উৎসব
পৌষ সংক্রান্তির সময় সবসময়ই শীতকাল। ফলে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে গড়ে উঠেছে বাঙালির প্রায়দিনব্যাপি ঘুড়ি উড়ানো উৎসব। এইদিন ঘুড়ি উড়ানোর জন্য তারা আগে থেকে ঘুড়ি বানিয়ে এবং সুতায় মাঞ্জা দিয়ে প্রস্তুতি নেয়। ঘুড়ি উৎসব বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী একটি উৎসব। মুঘল আমল থেকে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এই উৎসবে প্রচুর লোক সমাগম ঘটে। পুরোন ঢাকার অধিবাসীদের কাছে এটি অত্যন্ত উৎসবমুখর দিন হিসেবে পালিত হয়।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মকর সংক্রান্তি বা পৌষসংক্রান্তি-তে মূলত নতুন ফসলের উৎসব ‘পৌষ পার্বণ’ উদযাপিত হয়। নতুন ধান, খেজুরের গুড় এবং পাটালি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী পিঠা তৈরি করা হয়, যার জন্য প্রয়োজন হয় চালের গুঁড়া, নারিকেল, দুধ আর খেজুরের গুড়। মকরসংক্রান্তি নতুন ফসলের উৎসব ছাড়াও ভারতীয় সংস্কৃতিতে ‘উত্তরায়ণের সূচনা’ হিসেবে পরিচিত। একে অশুভ সময়ের শেষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, পঞ্জিকা মতে, জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয়। এই দিনে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত সাগরদ্বীপে মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে কপিল মুনির আশ্রমকে কেন্দ্র করে পুণ্যস্নান ও বিরাট মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সহস্রাধিক পুণ্যার্থী ও অন্যান্য রাজ্য থেকে আগত দর্শনার্থীদের সমাগম হয় এই মেলায়।
আউনি বাউনি
আউনি বাউনি বা আগলওয়া পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে পালিত একটি শস্যোৎসব। এই উৎসব ক্ষেতের পাকা ধান প্রথম ঘরে তোলা উপলক্ষে কৃষকের ঘরে পালনীয় একটি অনুষ্ঠান।
হেমন্তকালে আমন ধান ঘরে প্রথম তোলার প্রতীক হিসেবে কয়েকটি পাকা ধানের শিষ ঘরে এনে কিছু নির্দিষ্ট আচার অনুষ্ঠান পালন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে পৌষ সংক্রান্তির দিন দু-তিনটি ধানের শিষ বিনুনি করে ‘আউনি বাউনি’ তৈরি করা হয়। শিষের অভাবে দু-তিনটি খড় একত্রে লম্বা করে পাকিয়ে তার সঙ্গে ধানের শিষ, মুলোর ফুল, সরষে-ফুল, আমপাতা ইত্যাদি গেঁথে ‘আউনি বাউনি’ তৈরি করারও রেওয়াজ রয়েছে। এই আউনি বাউনি ধানের গোলা, ঢেঁকি, বাক্স-পেটরা-তোরঙ্গ ইত্যাদির উপর এবং খড়ের চালে গুঁজে দেওয়া হয়। বছরের প্রথম ফসলকে অতিপবিত্র ও সৌভাগ্যদায়ক মনে করে একটি পবিত্র ঘটে সারা বছর ধরে সংরক্ষণ করা হয়। এই আচারটিকেই ‘আউনি বাউনি’ বলা হয়। উত্তর ভারতে এই দিন লোহরি উৎসব পালিত হয়। আর অহমিয়ারা মেতে উঠেন ভোগালি বিহু’র উৎসবে।
দক্ষিণ ভারতে উদযাপিত হয় পোঙ্গাল। বৃহৎ ভারতই শুধু নয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ায় এই দিবস বা ক্ষণকে ঘিরে উদযাপিত হয় উৎসব। নেপালে এই দিবসটির নাম মাঘি, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি মা লাও, মিয়ানমারে থিং ইয়ান এবং কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান নামে উদযাপিত হয়। অবশ্যিকভাবে দেশ ভেদে এর নামের মতোই উৎসবের ধরণে থাকে পার্থক্য।
প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারতেও এই দিনের তাৎপর্য সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। তাই সামাজিক এবং ভৌগোলিক গুরুত্ব ছাড়াও এই দিনটি ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় গুরুত্ব বহন করে।
পশ্চিম ভারতের গুজরাটে উৎসবটি আরো অনেক বড় আকারে উদযাপিত হয়। মানুষ, সূর্যশক্তির কাছে নিজেদের ইচ্ছা বা আকূতিকে সুন্দর সুন্দর ঘুড়ির মাধ্যমে প্রকাশ করতে পালন করে ঘুড়ি উৎসব, যা মূলত শক্তির আধার প্রিয় দেবতার কাছে পৌঁছানোর জন্য একটি রূপক বা প্রতীকী আকুতি। গ্রামগঞ্জে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ হিসেবে মোরগ লড়াই হয়। যেহেতু উৎসবটি শীতের মাঝামাঝি সময়ে উদযাপিত হয়, সেহেতু এই উৎসবে এমন ধরণের খাবার তৈরি করা হয়, যা শরীরকে উষ্ণ রাখে এবং বেশ শক্তি জোগায়। গুড় দিয়ে তৈরি তিলের লাড্ডু এই উৎসবের অন্যতম উপাদেয় খাবার।
মহারাষ্ট্রে একে বলা হয় ‘তিলগুল’। কর্ণাটকে একে বলা হয় ‘ইল্লু বিল্লা’। অন্য কিছু প্রদেশে গবাদিপশুকে নানা রঙে সজ্জিত করা হয় এবং আগুনের ওপর দিয়ে ঝাঁপ দেওয়ানো হয়। তামিলনাড়ুতে পালিত হয় পোঙ্গল বা নবান্ন উৎসব। এতোদিন তামিলনাড়ুতে এই উৎসবের মূল আকর্ষণ ছিল ‘জাল্লিকাট্টু’। কিন্তু এবার আর হচ্ছে না ‘জাল্লিকাট্টু’। (সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, উইকিপিডিয়া, পঞ্জিকা, জাগরণ, এইমাত্র.কম ও অন্যান্য কিছু পুস্তিকা। ছবি কৃতিত্ব: আনন্দবাজার ও জাগরণ)