– রেণু লুৎফা
এই কভিড কালে আমাদের সংকীর্ণ জীবনায়নে কত যে ত্যাগ স্বীকার করতে হচ্ছে তার হিসাব মিলানো যাচ্ছে না। তীব্র মহামারী স্রোতের আবর্তে কে কোথায় কখন হারিয়ে যাচ্ছেন তারও হিসাব রাখা যাচ্ছে না। গত বৃহস্পতিবার (২১/১/২১) চলে গেলেন আমাদের কুলসুম আপা। বৃটেনে বাংলাদেশী নারী জাগরনের এক নীরব কর্মী। বয়স হয়েছিল। বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা ছিল। কিছু দিন আগে পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়ে হাস্পাতালে ছিলেন। তার আর বাড়ি ফেরা হলো না। শেষ যাত্রায় বিদায় জানানো গেল না। নীরবে নিভূতে চোখের জল ফেলা হয়েছে কেবল।
প্রথম দেখাতেই মনে হয়েছিল তিনি আরো ৫/১০ জন মহিলার মতো নয়। কি এক অসাধারন বুদ্বিদীপ্ত চেহারা। ১৯৬৩ সালে লন্ডন এসেছিলেন। প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মরহুম নজিব উল্লাহ সাহেবের সহধর্মিণী। স্বামীর সাথে একাত্তরে বৃটেনের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ড্রাইভ করে বেড়িয়েছেন জনমত ও অর্থ সংগ্রহের প্রচেষ্টায়। মহিলা সমিতির পক্ষে রাস্তায় রাস্তায় নানা ধরনের দ্রব্য বিক্রি করেছেন অর্থ সংগ্রহের জন্য। মহিলাদের সাথে নিয়ে মিটিং মিছিলে উপস্থিত হয়েছেন। সে সময় যে গুটিকয়েক মহিলা গাড়ী চালাতেন তার মধ্যে ছিলেন আমাদের কুলসুম আপা।
স্বাধীনতা যুদ্ধে বৃটেনের মহিলাদের অবদান পুরুষদের চেয়ে কোন অংশেই কম ছিলনা। লন্ডনের পথে পথে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মহিলাদের সাথে করে নিয়ে এসেছেন। হাইড পার্ক, ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট এ জমায়েত হয়েছেন।পাকিস্তানি দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করেছেন। লুলু বিলকিস বানু এক সাক্ষাৎ কারে বলেছিলেন, কুলসুম উল্লাহ আমাদের সাথে ছিলেন বলেই মহিলাদের নিয়ে মিটিং মিছিল করা আমাদের জন্য সফল হয়েছিল৷ কমিউনিটির মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করতেন তার কথায় নিজেদের বাড়ির মহিলাদের মিটিং মিছিলে অংশ গ্রহনে বাধা দিতেন না। মহিলারা তাদের শিশু সন্তানদের নিয়ে মিছিলে অংশ নিয়েছেন। নজিব উল্লাহ সাহেবের সাথে কমিউনিটির প্রতিটি মিটিংয়ে তিনি উপস্থিত থাকতেন। মহিলা সমিতির একজন কর্মঠ সদস্য ছিলেন তিনি। সমিতির মিটিংয়ে তার ছিল সরব উপস্থিতি।
আমার সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক কখন যে গভীরতা পায় তা নিজেই টের পাইনি। প্রায় প্রতি ঈদেই ডাক যোগে একটা প্যাকেট পেতে শুরু করি সুন্দর হাতে লিখা একটি চিঠি সহ। ২/১ বার দেশ থেকে আমার জন্য বইও নিয়ে এসেছেন।
সপ্তাহে রুটিন করে তাকে ফোন করা হতো। আমি ফোন না করলে তিনি ফোন করতেন। বিগত ২/৩ বছর থেকে চলাফেরায় তার সহযোগি লাগতো। বেশী কথা বার্তা বলতে পারতেন না। ফোন করাও বন্ধ হয়ে যায়। তবে প্রায়ই কিবরিয়ার কাছ থেকে খবর নিতাম।
কুলসুম আপার খুব ইচ্ছে ছিল আমি যেন একদিন তার বাড়িতে নাইওর যাই কিছুটা সময় কাটানোর জন্য। তিনি আমাকে রান্না করে খাওয়াবেন। আসছি করে করে আমার কখনো যাওয়া হয়নি।
কুলসুম আপা ওপারে ভাল থাকবেন।
|