প্রায় ৩মাস আগে গত সেপ্টেম্বরে বার্মিজ মুসলিম এসোসিয়েশনের সম্পাদক কিয়াও উইন খুবই তথ্যবহুল এই নিবন্ধটি ‘নিউ মানডালা’ নামক এক ম্যাগাজিনে লিখেছিলেন। সেখান থেকে সংগ্রহ করে তার বুঙ্গানুবাদ এখানে তুলে ধরা হল। রোহিঙ্গা হত্যার নেপথ্যকাহিনী অনেকটাই অনুধাবন করা যাবে এ নিবন্ধ থেকে।
কিভাবে ধর্ম ভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করা হলো, ব্রহ্মদেশের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে নিগৃহীত করার জন্য। লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গার দেশত্যাগ ও মুক্ত আকাশের তলায় বাংলাদেশে তাদের আশ্রয়ের শোচনীয় অবস্থা অবর্ননীয়। বিগত আগষ্ট থেকে আজ অবদি সারা দুনিয়ার মানুষ তাদের নজর সেখান থেকে সরাতে পারছে না। প্রতিদিনই কিছু না কিছু একটা ঘটেই চলেছে। প্রানভয়ে পালিয়ে আসার সময় সাগরে নৌকাডুবিতে মৃত্যু, হাতীর পায়ের তলায় পিষ্ঠ হয়ে মৃত্যু কিংবা দালালের খপ্পরে পড়ে সঙ্গের সবকিছু দিয়ে উদ্ধার পাওয়া খুবই দুঃখজনক, বেদনাদায়ক ও নিন্দনীয় যার অনেককিছুই বাস্তবে দেখিয়ে দেয়ার মত নয়। বিভিন্ন আয় উন্নতির ভুয়া কাহিনী শুনিয়ে প্ররোচিত করে যুবতীদের দেহব্যবসায় লাগানো শুনতে যতই খারাপ লাগুক এটাই সত্য। সবচেয়ে অবাক করা সত্য হল যে দুনিয়ায় অনন্ত শান্তির বাণী প্রচারকারী প্রাচীনতম ধর্মীয় বিশ্বাস গৌতম বুদ্ধের অনুসারী বুদ্ধরা এমন আকামটি করছে।
কেনো এই নিরীহ রোহিঙ্গাদের আরাকান থেকে নির্মমতার চরম উদাহরণ সৃষ্টি করে অগনিত নর-নারী-শিশুকে হত্যার মধ্যদিয়ে চিরতরে উচ্ছেদ করে দেয়া হচ্ছে, বিষয়টি বুঝে উঠতে একটু সময় লেগেছে। মায়ানমারের মানবতাবিরোধী এই হত্যাকান্ডের মূলে কি রয়েছে তা আজও মূলতঃ অজানা। তবে এযাবৎ যারা এই নরহত্যাকে অনুসরণ করে লিখছেন তাদের তথ্য থেকে যা পাওয়া যায় তা হলো- অনেকের মতে চীনদেশের বিশাল বিনিয়োগের কর্মযজ্ঞের নিরাপদ ব্যবস্থা করে দেয়ার তাগিদে এদের মারপিট করে স্থানত্যাগী করা হয়েছে। শুধুই তা নয়, এর সাথে রয়েছে এক ঢিলে দু’টো পাখিমারার মন্ত্র বলে অন্যরা ভাবছেন। তাদের মতে, এই রোহিঙ্গারা মূলগতভাবে ব্রহ্মদেশের মানুষ নয়। এরা বাঙ্গালী এবং মুসলমান। এরা সময় সময় জিহাদী হাক দেয়। ইদানিং এরা আইএস’দের সাথে সংযুক্ত হয়ে সশস্ত্র লড়াইয়ের হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে। গেল আগষ্টে তাদের সেই সশস্ত্র হত্যার শিকার হয়েছে মায়ানমারের নিরাপত্ত্বা বাহিনী। সুতরাং এদের উচ্ছেদ করতেই হবে।
একনায়কদের জন্য “ভাগ কর ও শাসন কর” নীতি খুবই কাজে লাগানোর মত একটি নীতি এবং তাই খুবই প্রিয়। মায়ানমারে Thein Sein’s সরকার মুসলিম বিরুধী মনোভাবকে লালন করার জন্য এই নীতিকে খুবই কাজে লাগিয়েছিল এবং যন্ত্রনা দিয়ে মুসলমান নিধনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে গেছে। মায়ানমারে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, ঘন মুসলমান বসতির বাংলাদেশ বৌদ্ধ ধর্মের জন্য খুবই হুমকি স্বরূপ! যারা মায়ানমারে তাদের জনগোষ্ঠীকে পাচার করেই চলেছে।
গবেষণা করে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে এ ধরনের কোন হুমকি কখনই ছিলনা কিন্তু রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী হিসেবে মানুষকে ভুল বুঝিয়ে একে হুমকি বানিয়ে নেয়া হয়েছে।
ধর্মজাতিগত জাতীয়তাবাদী কিছু অভিযানও পরিলক্ষিত হয় যাদের উদ্দেশ্য হল মায়ানমারে যে রোহিঙ্গা বলে একটি জাতিগোষ্ঠীর বাস্তব ঐতিহাসিক ও আইনী অস্তিত্ব আছে তাকে মুছে দেয়া। ধারাবাহিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক নির্যাতন চালানো হয়েছে এ লক্ষ্যে পৌঁছতে। এ ধরনের কাজকে সঙ্গায়িত করলে দাঁড়ায়-“গণহত্যা”! বাস্তব অস্তিত্বকে নিশ্চিন্ন করতে মুসলমান বিরুধী সুসংগঠিত হত্যাকান্ডের মত অনুশীলন চালানো হয়েছে, বৈষম্যমূলক নাগরীকত্ব আইন প্রতিষ্ঠা করে, বেঁচে থাকার মামুলি বিষয়গুলোকে দুষ্প্রাপ্য-দূর্লভ করে তোলে, হত্যাকান্ড এবং নিরাপত্ত্বা বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে; এ কৌশল গুলোর সবক’টিই প্রনয়ন করা হয় উদ্দেশ্য মূলকভাবে একজনকে তার পৈত্রিক ভিটামাটি ছেড়ে পলাতক হতে।
উত্তর আরাকানের রোহিঙ্গারা বলতে গেলে একটি খোলা কয়েদখানায় বাস করে আসছে, বিশেষ করে রাখাইন রাজধানী সীথে শহরের অং মিঙ্গালার ঘিঞ্জি বস্তি সে রকমই একটি উন্মুক্ত বন্ধীশালা।
এখানে রাখাইনদের মৌলিক মানবিক অধিকার প্রতিদিনই লংঘন করা হয়। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, উত্তর আরাকানের স্বাস্থসেবা কার্যক্রমের অবস্থা আতংকজনক! ‘একশন কন্ট্রে লা ফাইম’ এর ২০১২ সালের জরিপানুযায়ী শিশুমৃত্যুর হার দুঃখজনকভাবে অতি উচ্চে। তাদের বর্ণনায় জানা যায় যে সারা উত্তর আরাকানে মাত্র ৪২জন নার্স আছে যার অর্থ দাঁড়ায় প্রতি ১৮,৪০০জন মানুষের জন্য মাত্র ১জন নার্স। মঙ্গদো শহরের ৫৮ হাজার মানুষের জন্য মাত্র ১জন নার্স!
পক্ষান্তরে জাতীয় গড় হল প্রতি ৩০৪জনের জন্য একজন নার্স। সর্বসাকুল্যে ২১ টি গ্রামীন স্বাস্থসেবা কেন্দ্র আছে। যার অর্থ দাঁড়ায় প্রতি ৩৮,০০০ মানুষের জন্য একটি কেন্দ্র।
রোহিঙ্গাদের সরাসরি নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে বিধিবহির্ভুত স্বেচ্ছাচারীভাবে গ্রেপ্তার, নির্যাতন, হরণ করে নিয়ে যাওয়া এবং আইনের আওতায় না এনে হত্যা ইত্যাদি পথে। বহু মামলায় নির্যাতীতের আত্মীয় স্বজনকে অত্যাচার করা হয়েছে এবং তাদের স্বজনদের মুক্তির জন্য কিছু না কিছু দক্ষিণা দিতে বাধ্য করা হয়েছে। এ অবস্থায় প্রানে বাঁচার তাগিদে ভয়ঙ্কর সমুদ্রযাত্রা ছাড়া ভিন্ন কোন উপায় নেই তাদের কাছে।
জাতিসংঘের অভিবাসি সংক্রান্ত হাইকমিশনারস(UNHCR)এর এক বর্ণনায় পাওয়া যায় যে ২০১৪ সালে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা প্রান বাঁচাতে নিকটস্ত প্রতিবেশী দেশগুলিতে পালিয়ে যায় এবং ২০১৫ সালের প্রথম ৩মাসে আরো ২৫হাজার পালায়ন করে। এ সময় যদিও ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া ৮হাজার রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে। এরপরও আরো প্রায় ১.২ মিলিয়ন রোহিঙ্গা কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেবে?
এই সংখ্যালঘুদের উপর হত্যা-নির্যাতন নতুন কিছু নয়। এই হ্ত্যা-নির্যাতনের এক দীর্ঘ কালো ইতিহাস মায়ানমারের আছে। অতীতে সে দেশের আইন প্রনয়ণকারী আর ইতিহাসবিদেরা এই রোহিঙ্গাদের আইনী অবস্থান ও বসবাসের ঐতিহাসিক প্রমাণ বিনষ্টে একযোগ হয়ে কাজে লাগে। ঐতিহাসিক সেই নিশ্চিন্নকরণ এখনও চলছে।
বিগত ১৯৭৩ সালের আদমশুমারিতে এই রোহিঙ্গা ও অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মুসলমানদের মায়ানমারের দেশজ সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। এ সময় ১৪৩টি সংখ্যালঘু দলকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছিল। পরে ১৯৮২ সালের নাগরীকত্ব আইন ওই ক্ষুদ্র জাতিগুষ্ঠীর তালিকা থেকে মুসলমানদের বাদ দিয়ে দেয়া হয় শুধুমাত্র ‘কামান’গন ছাড়া। ১৯৮২ সালের সেই বিতর্কিত নাগরীকত্ব আইন কেবলমাত্র ‘কাচিন’, ‘কায়াহ’, ‘কারেন’, ‘চিন’, ‘বুরমেন’, ‘মন’, ‘রাখাইন’, ‘সান’ এবং অন্যান্য কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতিগুষ্ঠী যারা মায়ানমারের সীমান্তে ১৮২৩ সাল থেকে বসতি স্থাপন করে বসবাস করে আসছে তাদেরকে নাগরীক বলে স্বীকার করে।
ওই সময়ই রাখাইনের ইতিহাসবিদগন দাবী করে যে এই রোহিঙ্গারা ১৮২৪ সালের প্রথম এঙ্গলো-বার্মিজ যুদ্ধের পরে ক্রীতদাস হিসেবে মায়ানমারে বসতি গড়ে তুলেছিল অতএব এরা বহিরাগত বিদেশী। ওই নাগরীকত্ব আইন এবং ইতিহাসবিদদের ধারণা মূলতঃ অন্য কিছুই নয় শুধুমাত্র ধর্মভিত্তিক জাতিগত জাতীয়তাবাদ বা বুরমেনিকরণের একটি প্রক্রিয়া মাত্র।
অবশ্য রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান খুবই সহজ বিষয় নয় এবং এর ধর্মীয় দিকটিকে বাদদিয়ে কোন সমাধান সম্ভব নয়। যদিও ‘ইন্টারফেইথ’ প্রচার কাজ দেশের অনেক জায়গায়ই হয়েছে কিন্তু সহাবস্থানের ধারনা গহীন গ্রামীন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছায়নি। বরং সরকারী আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে দাবদাহের মত ঘৃণাছড়ানো বক্তব্য, বৈষম্যমূলক আচরণ এবং হিংস্রতা হয়েই চলেছে।
সূত্র: কিয়াও উইন। বার্মা মানবাধিকার নেটওয়ার্ক ও বার্মিজ মুসলিম এসোসিয়েশনের সম্পাদক কিয়াও উইন এর লেখার অনুবাদ। কিয়াও এ নিবন্ধটি গত সেপ্টেম্বরে লিখেছিলেন। অনুবাদ হারুনূর রশীদ।