মহিদুর রহমান
পৃথিবীর তাবৎ মানুষের দৃষ্টি এখন মধ্যপ্রাচ্যের উপকূলীয় অঞ্চলের দিকে। ইসরাইল-ফিলিস্তিনের ভয়াবহ যুদ্ধের বিভীষিকা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে প্রাণ হারাচ্ছেন দুই দেশেরই নারী-শিশুসহ নিরপরাধ সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল ফিলিস্তিনি নিয়ন্ত্রিত গাজায় চলছে নারকীয় তাণ্ডব। এ যেন প্রতিশোধের যুদ্ধ। এই ক’দিন আগেও তো এ অঞ্চলটি শান্ত ছিল। মানুষ নির্বিঘ্নে গ্রহণ করছিল পৃথিবীর আলো-বাতাস। কিন্তু কেন হঠাৎ করে অশান্ত হয়ে ওঠলো উপকূলীয় এ অঞ্চল?
এর উত্তর সবারই জানা। গত ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সদস্যরা অতর্কিতে কাঁটাতারের বেড়া ভেঙে ঢোকে পড়ে ইসরাইলে। তারা ইসরাইলের অভ্যন্তরে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং বেশকিছু নাগরিককে বন্দি করে নিয়ে আসে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের স্বীকৃতির পর এবারই প্রথমবারের মতো এমন আক্রমণ দেখল ইহুদি এ রাষ্ট্রটি। এই ঘটনা ইসরাইলকে স্তম্বিত করে দেয়। তাই তারা প্রতিশোধের নেশায় মরিয়া হয়ে ওঠে। পাল্টা আঘাত হানতে শুরু করে। ইসরাইলের ভাবা উচিত যে, কিছু মানুষের ভুলে হাজার হাজার নিষ্পাপ শিশু নিধন যুদ্ধ হতে পারে না। এটি গণহত্যা।
ফিলিস্তিনিরা স্থায়ী আবাসভূমির জন্য স্বাধীনতা চাইবে এটা তাদের মৌলিক অধিকার। কিন্তু তাদেরও তো ভাবা উচিত যে, সামরিক শক্তির দিক দিয়ে ইসরাইলের অবস্থান কতটা সুসংহত? ইসরাইলের রয়েছে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের বিশাল ভাণ্ডার। তাছাড়া সেনা-নৌ-বিমান ও আধা সামরিক বাহিনীতে রয়েছে ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০ সক্রিয় সদস্য। রয়েছে ৪ লাখ ৬৫ হাজার সদস্যের রিজার্ভ বাহিনী। এর মধ্যে আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য আট হাজার। ইসরায়েলে ১৮ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ বাধ্যতামূলক। ইসরাইল কম জনসংখ্যার দেশ হলেও স্থল নৌ ও আকাশ পথে হামলা ও আকাশ প্রতিরক্ষার সক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। সবকিছু মিলে মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র ইসরাইল। তারা রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পৃথিবীর অনেক দেশে সমরাস্ত্রও রফতানি করে থাকে। ইসরায়েলের পারমাণবিক ক্ষমতাও রয়েছে বলে মনে করা হয়। দেশটির কাছে অত্যাধুনিক ব্যালেস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং পারমাণবিক ওয়ারহেড বহনে সক্ষম বিমান পর্যন্ত রয়েছে।
পার্শ্ববর্তী দেশ মিসর, সিরিয়া এমন কি ইরানে পর্যন্ত হামলা করতে তাদের সক্ষমতা রয়েছে। আর বিশ্বের শক্তিধর যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ইত্যাদি দেশ তো তাদের পেছনে আছেই। এখানে উভয় পক্ষের কিছু পরিসংখ্যান দিলে সামর্থ্যের দিকটা আরেকটু স্পষ্ট হবে। ২০১৮-২০২২ মেয়াদে সামরিক খাতে ইসরাইলের মাথাপিছু ব্যয় ২ হাজার ৫৩৫ মার্কিন ডলার, যা বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মাথাপিছু সামরিক ব্যয়। ২০২২ সালে ইসরায়েল জিডিপির ৪ দশমিক ৫ শতাংশ সামরিক খাতে ব্যয় করেছে, যা বিশ্বে দশম।
পক্ষান্তরে ফিলিস্তিনের নিয়মিত কোনও সেনাবাহিনীই নেই। বিভিন্ন গ্রুপ মিলে ৩০ থেকে ৫০ হাজার সদস্য রয়েছে। এর মধ্যে হামাসের রয়েছে ১০-২০ হাজার। কাসেম ব্রিগেডের ৭-১০ হাজার। এছাড়া ফিলিস্তিন ইসলামি জিহাদের ৯-১০ হাজার। আর হামাসের নিজস্ব অস্ত্র বলতে ১০০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার রেঞ্জের কয়েক ডজন রকেট রয়েছে। ৭০-৮০ কিলোমিটার রেঞ্জের আরও কিছু রকেট রয়েছে। নতুন উদ্ভাবিত একটি রকেটের পাল্লা আড়াইশ কিলোমিটার বলে জানিয়েছে হামাস। কিছু অস্ত্র হয়তো তারা নিজেরাও তৈরি করছে কিন্তু তা অপ্রতুল।
তবে তাদের পেছনে রয়েছে সামরিক শক্তিতে বলীয়ান ইরান। বর্তমানে ইরানের ৫ লাখ ২৩ হাজার সক্রিয় সেনাসদস্য রয়েছে। সংরক্ষিত সদস্য রয়েছে ৩ লাখ ৫০ হাজার জন। এছাড়া দেশটির সামরিক প্রশিক্ষিত জনসংখ্যা ২ কোটি ৩৬ লাখ ১৯ হাজার ২১৫ জন। ইরানের হাতে অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান, সাবমেরিন ছাড়াও ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এসব ক্ষেপণাস্ত্র অনেক ক্ষেত্রেই সৌদি আরব ও উপসাগরীয় এলাকার অনেক ইসরাইলি লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করতে সক্ষম।
তবে পারমানবিক শক্তিতে ইরান এখন পর্যন্ত পিছিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র, উত্তর কোরিয়ার মতো পারমাণবিক শক্তি রাষ্ট্র নয় ইরান। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ৭ হাজার ২০০টি পারমাণবিক বোমা রয়েছে। এদিকে ইসরাইলের রয়েছে ২০০টি। যেখানে ইরানের হাতে একটিও নেই। ফিলিস্তিনের পেছনে শক্তিধর ইরান থাকলেও তাদের মনে রাখতে হবে বিশ্বমোড়ল রাষ্ট্র আমেরিকা অনেকটা প্রকাশ্যে ইসরাইলকে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপীয় অন্যান্য কয়েকটি দেশও রয়েছে তাদের পেছনে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অনেকেই মনে করেছিলেন ইউক্রেন রশিয়ার সামনে দাঁড়াতেই পারবে না। কিন্তু ফলতঃ কী দেখা গেল? আজ পর্যন্ত রাশিয়া কি পেরেছে ইউক্রেনকে পরাস্ত করতে? তবে বাস্তবে ইউক্রেন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। নারী শিশুসহ সাধারণ মানুষ শুধু মারাই পড়ছেন না গৃহহারাও হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ।
ইসরাইল জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে যে জায়গায় অবস্থান করছে সেখান থেকে যোজন যোজন পথ পেছনে রয়েছে ফিলিস্তিন। এমন কি ইরান তথা মুসলিমবিশ্ব। এ প্রেক্ষিতে তাদের সাথে যুদ্ধ করে জয় ছিনিয়ে নেওয়া আকাশকুসুম কল্পনা। তাই যুদ্ধ নয় একমাত্র সন্ধি বা চুক্তি করেই এই সময়ে শান্তি প্রতিষ্টা সম্ভব। তা না হলে এ অঞ্চলে মানবিক বিপর্যয় আরও প্রকট আকার ধারণ করবে যা মানবতার জন্য খুই লজ্জাকর।