রাজঘাট, গান্ধী সমাধি
রাজঘাট, নামেই বুঝা যায়,
রাজার বাড়ীর জাঙ্গাল যে সে, ইতিহাস দেয় সায়।
একসময় এই ঘাটে,
সওদাগরি নৌকা এসে ভিড় জমাতো হাটে।
চৌদেয়ালে ঘেরা রাজবাড়ীর এই ঘাট,
দুনিয়ার কত রাজা ভূপতি চুকিয়ে রাজ্যপাট,
রাজদর্শনে এসেছেন কত ভূবনখ্যাত রতি-মহারতি;
রাজা মহারাজ ভূবনসেরা কতই নরপতি।
কত বিশ্বখ্যাত জ্ঞানী-গুণীর পদধূলায় ঘাট পেয়েছে প্রাণ।
জানিনা কোথায়ও লিখেছে কি সব, গেয়েছে কি কেউ গান।
আজও ভূবনখ্যাত তাজমহলের পাশ ঘেঁষে বয় বৃদ্ধা যমুনা,
তার তীরেই এই রাজঘাট নেই কোন শাহানশাহ।
কত শূর-মহাশূর, বীর আফগান,
আরবী, ইরানি, মারাঠি; শক, হুন আর তুর্কী, আর্মেনীয়ান;
সাসানি, চাইনিজ, ইংরাজ; ওলন্দাজ, পর্তূগীজ,
এই ঘাট দিয়ে এসেছে গিয়েছে বেশুমার, বেহিসেব।
-হারুনূর রশীদ
আমাদের ভাড়াগাড়ীর চালক বিহারের কাইয়ুম মিয়া রাজঘাট লিখা দেখিয়ে রাস্তার পাশেই ছোট্ট পরীক্ষা পথের(চেকপোস্ট) কাছে আমাদের নামিয়ে দিলেন। কোন ঝঞ্জাট একেবারেই নেই বলে দিয়ে রাস্তার অপর পাশের গাড়ী পার্কিং এ গাড়ী নিয়ে অবস্থানের কথা জানিয়ে গাড়ী ঘুরিয়ে নিল। আমরা ধীরে ধীরে চেকপোস্টে শরীর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কৃষ্ণকুঞ্জবনসম সৌধাঞ্চলে প্রবেশ করলাম। খুবই গোছিয়ে রাখা নিকুঞ্জকাননের মত। প্রবেশ পথের দুপাশে সারি সারি বৃক্ষরাজি ছায়ার হাতছানি দিয়ে সুশীতল বায়ূর পরশে মনকে উদাস করে দেয়। কত রকমারি বৃক্ষ আর ফুলরাশিতে সাজানো।চোখ জুড়ানো প্রাকৃতিক সৌন্ধর্য্যের মোহিতরূপে অভিভুত মন চলে যায় দূরে বহুদূরের অতীতে, ইতিহাসের পাতায়। ভারতীয় রাজনীতির রক্তাক্ত ধনবাদী পথে হাটার অভিশপ্ত সূচনায়। এক মর্মান্তিক পশুসুলভ হত্যাচিত্র চোখের পুতুলিতে ভেসে উঠে। পুস্তক-পত্রিকায় দেখা মহাত্মা গান্ধীর নির্মম হত্যাচিত্র। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও তস্য পুত্র রাজিব গান্ধীর বর্বর হত্যাচিত্র। স্বার্থান্ধ সুবিধাবাদী গুষ্ঠীর ভ্রান্ত বানোয়াট ধর্মান্ধ রাজনীতির ফুলসিরাত পাড় হতে কত লক্ষকোটি মানুষকেই না অকারণে প্রান দিতে হয়েছে এই ভূখন্ডের আজাদীর নামে। হায়রে স্বার্থান্ধ ধনবাদী আজাদী!
রাজঘাট, নামেই বুঝা যায় কোন রাজা-বাদশাহের কারণে নামের এই রূপ। হ্যাঁ, ইতিহাসও তাই। একসময় এই ঘাটে দুনিয়ার সব সওদাগরি নৌকা এমনকি জাহাজও ভিড়তো। চৌদেয়াল ঘেরা রাজবাড়ীর প্রবেশ পথও ছিল এই ঘাট। তখনকার দুনিয়ার কত রতি-মহারতি এই ঘাট দিয়ে রাজদর্শনে এসেছেন, কত বিশ্বখ্যাত জ্ঞানী-গুণীর পদধূলা পেয়েছে এই ঘাট, জানিনা কোথায়ও তার সব, কেউ লিপিবদ্ধ করে রেখেছে কি-না।
ভূবনখ্যাত তাজমহলের পাশ ঘেষা পৌরাণিক নদী যমুনার তীরে, শাহজাহানাবাদের বহু পুরাতন ঐতিহাসিক এই ঘাট। এখানে এসেছেন কত মারাঠি, আফগান, কত ইংরেজ; আরবীয়ান, ওলন্দাজ, তুর্কী; আর্মেনীয়ান, কতশত পর্তুগীজ, শক আর হুনেরা এই ঘাট দিয়ে এসেছে গিয়েছে সে বেশুমার, বেহিসেব। কেউ এসেছেন উপঢৌকন নিয়ে আবার বহু এসেছেন নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়। অনেকেই এসেছেন নিজেদের ভাগ্য গড়ার সোনালী দিনের সম্ভাবনায়। আজানু নত হয়ে সালাম ঠুকে পেশ করেছেন বঞ্চিত জীবনের লালিত বাসনা কত রতি। নবরত্নের মহেশ দাস ভট্ট ওরফে রাজা বীর বল, উস্তাদ তানসেন, সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক আবুল ফজল, মহাযুদ্ধা ভগবন দাস, অর্থনীতিবিদ রাজা টোডরমল, বাংলা সনের প্রবর্তক ফতেহ উল্লাহ সিরাজ, বীর যোদ্ধা সেনাপতি জৈন খান, ঐতিহাসিক আব্দুল কাদের বদায়ুনী, ইশা খাঁ কেদার রায়ের এগারোসিন্ধু যুদ্ধখ্যাত সেনাপতি মানসিং সহ কত সাহসী গুণীজনের পদস্পর্শে ধন্য হয়ে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে এই ‘রাজঘাট’। দিল্লীর রাজবাড়ীর এই ‘রাজঘাট’।
রাজঘাট আজও আছে, আছে সেই রাজবাড়ী, নেই শুধু সেই রাজ! আজ সবই ইতিহাস। রাজঘাট। মূলতঃ যমুনার তীরে পুরাণ দিল্লীর চার দেয়াল ঘেরা রাজবাড়ীর একটি সদর ফটক, যাকে বাদশাহ শাহজাহান শাহজাহানাবাদ নাম দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন। সেই স্মৃতিকেই মানুষ স্মরণে রেখেছে পুরো এলাকাকে ‘রাজঘাট’ বলে ডেকে। তারই কাছাকাছি এই রাজঘাট এলাকায় মহাত্মা গান্ধীর চিতাভষ্ম আর এক অনির্বাণ শিখা রাখা আছে। আছে আরো বহু ভারতীয় রাজইতিহাসখ্যাত মহামানবের স্মৃতিসৌধ। বলতে গেলে পুরো রাজঘাটই খ্যাতিমানদের সৌধহাট। এই স্মৃতিসৌধ স্মরনীর পুরো এলাকাকেই এখন রাজঘাট বলে ডাকা হয়।
চারটি প্রশস্ত প্রবেশ পথসহ চৌদিকে সুউচ্চ দেয়ালঘেরা একটি বিশাল এলাকা নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর এই সমাধি সৌধের অবস্থান। দেয়ালের উপরে রয়েছে সাজানো ফুলের বাগান। উপরে উঠে দেয়ালের চারিদিকে হেটে উপর থেকে সৌধসৌন্দর্য্য দর্শনের জন্য প্রশস্ত রাস্তা রয়েছে। চার দেয়ালের ভেতরে ঠিক মাঝখানে একটি কালো প্রশস্ত মার্বেল পাথরের উপর এক অনির্বাণ শিখা যা মহাত্মা গান্ধীর শেষকৃত্যের স্মৃতি ধারণ করে কালের সাক্ষি হয়ে জ্বল জ্বল করে জ্বলছে অবিরাম। প্রতিদিন কালো মার্বল পাথরের পাটাতনকে ফুলের আল্পনা দিয়ে নতুন নতুন সাজে সাজানো হয়। ফুলের আলপনার সেই সাজ দর্শনার্থীদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়ার মত।
১৯৪৮-এ মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার পরের দিন ৩১শে জানুয়ারী এখানেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল। দিল্লী শহরকে প্রায় মাঝখানে রেখে বৃত্তাকারের যে সর্বশেষ সড়ক নির্মিত হয়েছে, মহাত্মা গান্ধী সড়ক বলে যার নামাকরণ করা হয়েছে তারই এক প্রান্তে যমুনারই তীরে পুরনো রাজফটক ঘাটের কাছাকাছিই এই সমাধিসৌধের অবস্থান। পাথরের তৈরী রাস্তা করে দেয়া হয়েছে মানুষের আনাগোনা সহজিকরণের জন্য। চার দেয়ালের ভেতরে গিয়ে সৌধ দেখতে পায়ের জুতো খুলে যেতে হয়। সারাটা ঘুরে ঘুরে মানব নির্মাণের কলাকৌশল দেখে দেখে মনকে তৃপ্ত করে নিলাম ভোজনবিলাসীদের মত। মাঝে মাঝে ছবিও তুলে নিলাম।
গান্ধীর এই সমাধি সৌধের স্থাননির্বাচন, সবুজবাগান ও বৃক্ষায়নের কাজটি করেছিলেন সেই সময়কার ভারত সরকারের ‘উদ্যান পালন’ কার্যক্রমের সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক এলিক পার্সি লাঙ্কাস্টার নামের একজন ইংলিশ মানুষ। এই রাজঘাট নামক সবুজ বনানীর কাছাকাছি বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন নামে কালের সাক্ষী বহু মহাপ্রান নেতা-নেতৃর সমাধি সংরক্ষন করা আছে। কাছাকাছি ঠিক উত্তরদিকেই রয়েছে মহামতি পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর সমাধি যে এলাকাকে বলা হয় ‘শান্তিবন’। তার কাছেই রয়েছে ভারতের দশম প্রেসিডেন্ট কচেরি রমন নারায়ণ যিনি আর কে নারায়ণ নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন, তার সমাধি। সেই সমাধি এলাকার নাম রাখা হয়েছে ‘একতা স্থল’।
গান্ধীর জন্মদিন অক্টোবর ২ ভারতের জাতীয় ছুটি, গান্ধী জয়ন্তী হিসাবে পালিত হয়। ২০০৭ সালের ১৫ জুন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গান্ধীর জন্মদিনকে বিশ্ব অহিংস দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। মহাত্মা গান্ধী বহুত্ববাদী ভারতীয় সমাজে সৌভ্রাতৃত্বপূর্ন সহাবস্থান আদর্শের বিশিষ্ট প্রবক্তা ছিলেন। তার যৌক্তিক অযৌক্তিক সমালোচনাও আছে অনেক। দক্ষিণ আফ্রিকায় লেখা গান্ধীর কিছু নিবন্ধ নিয়ে বিতর্ক করা হয়। পূণর্মুদ্রিত “দি কালেকটেড ওয়ার্কস অফ মহাত্মা গান্ধী” (ভলিউম ৮, পৃষ্ঠা.১২০) এ গান্ধী “ইণ্ডিয়ান ওপিনিয়ন” প্রবন্ধে ১৯০৮ সালের দক্ষিণ আফ্রিকার সম্পর্কে লিখেছিলেন, “অনেক স্থানীয় কয়েদী পশুত্ব থেকে কেবল একধাপ উপরে এবং প্রায়ই নিজেদের ভিতরে বিবাদ ও হানাহানি করত”। একই সংকলনের (ভলিউম ২, পৃষ্ঠা.৭৪)তে, গান্ধীর ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮৯৬ সালে দেয়া একটি ভাষণের উল্লেখ করা হয় যেখানে তিনি, যাদের পেশা শিকার করা এবং একমাত্র লক্ষ্য একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক গবাদি পশু জমিয়ে বউ ক্রয় করা তাদের কাফির বলেছিলেন। যদিও এসব ধোপে টেকার মত সমালোচনা নয়। নিজের বিষয়ে এর চেয়ে আরো বেশী সমালোচনামূলক লেখা গান্ধী নিজেই লিখে গিয়েছেন।
গান্ধী নিজে তার কিছু লেখায় বিস্ময়কর কিছু জীবন কথার উল্লেখ করেছেন। যেমন- তার ছোটবেলায় তিনি একদিন তার বড় ভাইয়ের হাতের সোনার মাদুলি চুরি করে খরচ করেন। পরে যখন বুঝতে পারেন এটা ঠিক করেননি। তখন বাবার কাছে সত্য স্বীকার করতে গিয়ে ভয় পেয়ে বলতে পারেননি। তিনি নিজেই লিখেছেন সেই ভয় তার বাবার মারের ভয় ছিলনা। সে ভয় ছিল একটি খারাপ কাজের কথা কোন মুখে বাবাকে বলবেন, সেই ভয়। বাবা মনে খুবই দুঃখ পাবেন। পরে ঠিক করেন, কাগজে লিখে বাবাকে জানাবেন। করেনও তাই। একটু অসুস্থ বিছানায় ঘুমন্ত বাবা পুত্রের চিঠি পরে মৃদু কাঁদলেন। তিনি দেখলেন বাবার চোখ দিয়ে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। বাবা আর কিছুই বললেন না। তিনি বুঝলেন তার সত্যস্বীকারে বাবা তার উপর আশ্বস্ত হয়েছেন এই ভেবে যে ছেলে কোনদিন আর একাজ করবে না। এভাবেই তার জীবনে খুব সুন্দর সুন্দর কিছু ঘটনা আছে যা তিনি নিজ আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন।