লন্ডন: শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বীর আব্দুল মুকিতের মাতা মিসেস শফিকুন্নেছা আজ রোববার রাতের দিকে পরলোক গমন করেছেন। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে মৌলভীবাজার শহরের একটি ক্লিনিকে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। সন্ধ্যার দিকে তার অবস্থার অবনতি ঘটলে তাঁকে সিলেট নিয়ে যাওয়ার পথেই পরলোক গমন করেন। মৌলভীবাজার শহরের কোর্ট রোডের যে বাসায় তিনি বসবাস করতেন, মুক্তিযুদ্ধে তার শহীদ ছেলে মুকিতের নামেই ওই বাসার নামাকরণ আছে ‘শহীদ মুকিত মঞ্জিল’ নামে।
শহীদ মুকিত মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট’ সংক্ষেপে বিএলএফ-এর একটি গেরিলা দলের সাথে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। ভারতে ফিরে যাবার পথে মৌলভীবাজার হাইল হাওরের দক্ষিন-পশ্চিম কোনে অবস্থিত সাতগাঁও এর কাছে আলিশার কুল গ্রামে সামনা-সামনি এক গ্রেনেড যুদ্ধে পাকিস্তান সমর্থক মুসলিম লীগার ও রাজাকার-আলবদরদের হাতে ধরা পড়েন। যতদূর জানা যায় মুকিতদের নিক্ষেপিত গ্রেনেড বিষ্ফোরিত না হওয়ায় শত্রুদের হাতে তারা বন্ধী হন। পরবর্তীতে পাকিস্তানীদের হাতে তাকে তার ৫ সহযোগিসহ হস্তান্তর করা হয়েছিল। এর পর থেকে মুকিত সহ ওই ৬জন মুক্তিযোদ্ধার কোন খবর আজ অবদি পাওয়া যায় নি। সকলেরই অনুমান পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী তাদের নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ গোপন করে নেয়।
মুক্তিযুদ্ধের পর মৌলভীবাজার আওয়ামীলীগ এসব তথ্য সংগ্রহের তেমন জোড়ালো কোন উদ্যোগ গ্রহন করেননি। জাতীয় বিএলএফ নেতৃত্বও তাদের হত্যাকান্ডের হদিস করার সফল কোন উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন বলেই আজ অবদি তাদের অন্তর্ধানের কোন সঠিক খবরের সুরাহা হয়নি। মুকিত জননী শফিকুন্নেছা তার ছেলের লাশ দেখার সুযোগই পাননি। সব মায়ের মত নিশ্চয়ই তারও মনে হয়তো কাজ করতো যে একদিন ছেলের কবর দেখার সৌভাগ্য তার হবে। কিন্তু তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জানতেও পারেননি তার ছেলে ও সঙ্গীদের লাশ কোথায় সমাধিস্ত করা হয়েছিল!
মুক্তিযুদ্ধের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কাছে ঢাকায় সিলেট বিএলএফ-এর অস্ত্র জমা দেয়ার পর সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে মৌলভীবাজারের তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা (পরবর্তীতে লন্ডনে হাইকমিশনার হয়ে অবসরে যান) গিয়াস উদ্দীন মনিরের সাথে দেখা করতে যাওয়ার পথে আমি হারুনূর রশীদ, প্রয়াত গাজী গোলাম সরওয়ার ও সৈয়দ নাসির উদ্দীনের হাতে, পলাশীর মোড়ে ধরা পড়েন মৌলভীবাজারের মুসলিম লীগ নেতা মরহুম ইনাম উল্লাহর পুত্র প্রয়াত সাজ্জাদুর রহমান। এ সময় আমাদের সাথে ছিলেন মৌলভীবাজারের সেই সময়কার বিএলএফ নেতা মাহমুদুর রহমান ও সিলেটের জেলা স্বেচ্ছাসেবক প্রধান বিএলএফ নেতা প্রয়াত আখতার আহমদ। গিয়াস উদ্দীন মনিরের মধ্যস্থতায় তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা শাহজাহান সিরাজের কাছে সাজ্জাদুর রহমানকে হস্তান্তর করা হয়। এসময় শাহজাহান সিরাজের সাথে মুকিতদের অন্তর্ধানের বিষয়ে খোঁজ নেয়ার আলাপ করলে শাহজাহান সিরাজ সাহেব প্রয়াত শেখ ফজলুল হক মনিভাইয়ের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দেন। হারুনূর রশীদ, সৈয়দ নাসির উদ্দীন, প্রয়াত গাজী গোলাম ছরওয়ার ও সিলেটের বিএলএফ নেতা প্রয়াত আকতার আহমদসহ আমরা সকলে মনিভাইয়ের কাছে লিখিতভাবে মুকিতদের নিরুদ্দেশের ঘটনা বর্ণনাপূর্বক তাদের খবর সংগ্রহের দরখাস্ত করি। মনিভাই নিজেই এরূপ দরখাস্ত লিখে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আকতার ভাই এসময় আমার সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে মনিভাইয়ের সাথে আলাপ করিয়ে দেন। মনিভাই আমাকে তার বাংলার বাণীতে সাংবাদিকতায় যোগ দেয়ার নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং এও বলেছিলেন যে তিনি কিছু দিনের মধ্যে মৌলভীবাজার যাবেন তখন যেন আমি তার সাথে ঢাকায় চলে আসার প্রস্তুতি রাখি। বেশ পরে তিনি অবশ্য মৌলভীবাজার এসেছিলেন এবং আমার খবর করেছিলেন। ততদিনে আমরা মনের দিক থেকে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছি। যার জন্য আমার আর বাংলারবাণীতে যাওয়া হয়ে উঠেনি। আমার স্থলে ওই সময় মৌলভীবাজার থেকে মতিউর রহমান চৌধুরীকে বাংলারবাণীতে সুযোগ দেয়া হয়।
ঢাকা থেকে ফিরে এসে সৈয়দ নাসির উদ্দীন, আশীদ্রোনের আসকির মিয়া, মাহমুদুর রহমান, আমি নিজে ও দেওয়ান আব্দুল ওহাব চৌধুরী ঘটনাস্থলে গিয়ে বহু খবর নেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সঠিক কোন তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। মুকিতদের যুদ্ধের সাথে জড়িত বেশ কয়েকজনকে ধরে এনে জেলে রাখা হয়। কিন্তু এ পর্যন্তই। এরপর আর মুকিতদের কোন হদিস করা সম্ভব হয়নি।
মুকিত বিএলএফ-এর যে দলের সাথে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিল সেই দলের মুকিতই ছিল দলনেতা আর আমি ছিলাম টুওয়াইচ অর্থাৎ সহকারী দলনেতা। সে হিসেবে এবং একজন একনিষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে খোঁজ নেয়ার বহু কঠিন পথে সে সময় হেটেছি কিন্তু সাহায্য সহায়তার অভাবে কোন সুরাহা করতে পারিনি। মুকিতদের অন্তর্ধানের সাথে সাথে আশীদ্রোনের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনীও গুম হয়ে য়ায়।