মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের কানিহাটি গ্রামে এখন দিগন্ত জুড়ে ফসলের মাঠ। এই গ্রামেরই সন্তান জিনবিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী। তার উদ্ভাবন করা নতুন এই জাতের ধান এবার চাষ হয়েছে নিজ গ্রামেই। অবিশ্বাস্য ভাবেই এই ধান একবার রোপনের পর পরপর পাঁচবার কাটা যায়। বছরে এই একই ধান গাছ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচবার ফসল পাওয়া যায়।
সরেজমিনে কুলাউড়ার কানিহাটি গ্রামে দেখা যায় গ্রামজুড়ে বিস্তৃর্ণ সোনালী ফসলের মাঠ। এই ফসলের মধ্যে জন্মেছে নতুন এই ইতিহাস সৃষ্টিকারী ধান। এই ধান একবার রোপণে বছরজুড়ে পাঁচবার ফলন এসেছে।
ধানের এ নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন জিনবিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী। প্রবাসী এ বিজ্ঞানী দীর্ঘদিন ধরে ধানের নতুন জাত আবিষ্কার নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আসছেন। এক ধান গাছ থেকে পাঁচবার ফলন পাওয়াতে তিনি সন্তুষ্ট নন। যাতে ছয়বার একই গাছ থেকে ধান পাওয়া যায় এ নিয়ে বর্তমানে গবেষণা করছেন। একই সাথে নতুন জাতের এ ধান যাতে সারাদেশে চাষাবাদ করা যায় সেই চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে শুরুটা কিভাবে হয়েছে সেটা তিনি এ প্রতিনিধিকে জানান।
তিনি বলেন, আমরা কৃষির উপরে খুব নির্ভরশীল ছিলাম। আমি দেখেছি যারা ধান চাষ করে তারা উন্নত জীবন যাপন করতে পারে না। এটা আমার জন্য খুব পীড়াদায়ক ছিল। কারণ আমরা কৃষি নির্ভর পরিবারের মানুষদের দেখেছি দেশে খুব অবহেলিত। মানুষ শুধু চায় কমদামে ধান পেতে। কিন্তু কৃষকরা যে মূল্য পাচ্ছে না, সেটা নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। আমি ব্যক্তিগতজীবনে কৃষিতে কিভাবে আয় বাড়ানো যায় ব্যয় কমানো যায় এটা নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তা করি। আমার চিন্তা এটা- একটা ধান জমিতে থাকবে বিশাল আকার ধারণ করে আর অনেক অনেক ধান দেবে। আমি এই জিনিসটাই করতে চেয়েছি। অত্যন্ত আনন্দের বিষয় আমি করতে পেরেছি। বোরো হিসেবে বছরের প্রথমে লাগানো এ ধান ১১০ দিন পর পেকেছে। ওই গাছেই পর্যায়ক্রমে ৪৫ দিন পরপর একবার বোরো, দুইবার আউশ এবং দুইবার আমন ধান পেকেছে। কম সময়ে পাকা এই ধানের উৎপাদন বেশি, খরচও কম। তবে প্রথম ফলনের চেয়ে পরের ফলনগুলোতে উৎপাদন কিছুটা কম। কিন্তু পাঁচবারের ফলন মিলিয়ে উৎপাদন প্রায় পাঁচ গুণ বেশি।
আবেদ চৌধুরী জানান, যে জাতগুলোর ধান পাকার পর কেটে নিয়ে গেলে আবার ধানের শীষ বের হয়, সেগুলো তিনি আলাদা করেন। এভাবে ১২টি জাত বের করেন। তিন বছর ধরে জাতগুলো চাষ করে দেখলেন, নিয়মিতভাবে এগুলো দ্বিতীয়বার ফলন দিচ্ছে। তারপর তিনি শুরু করেন একই গাছে তৃতীয়বার ফলনের গবেষণা। চারটি জাত একই গাছ থেকে পাঁচবার ফলন দিচ্ছে। এই চারটি জাতের ওপর ১০ বছর ধরে চলছে গবেষণা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বোরো ধানের এই চারটি জাত দুই বিঘা জমিতে রোপণ করা হয়। পরিমাণমতো ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা হয়। সঠিকভাবে সেচ ও পরিচর্যা করার পর ১১০ দিনের মধ্যে ৮৫ সেন্টিমিটার থেকে এক মিটার উচ্চতার গাছে ফসল আসে। পরে মাটি থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার উচ্চতায় পরিকল্পিতভাবে ওই ধান কেটে ফেলা হয়।
মে মাসে প্রথম দিকে প্রথমবার কাটা ধানে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হয়েছে চার টন। তারপর থেকে ৪৫ দিন অন্তর প্রতিটি মৌসুমে হেক্টরপ্রতি কখনও দুই টন, কখনও তিন টন ফলন এসেছে। সবগুলো জাত হেক্টরপ্রতি প্রায় ১৬ টন ফলন দিয়েছে। যেহেতু পাঁচবার চাষ হয় সেহেতু ‘প ব্রীহি’ নাম দিতে চাই। এখনও নিশ্চিত হয়নি। চাইছি আমার এলাকার নামেও দিতে।
তিনি বলেন, বছরের যে কোনো সময়ে এ ধান রোপণ করা যায়। এখন পরের ধাপগুলোতে কিছুটা কম উৎপাদন হচ্ছে। আমার চেষ্টা থাকবে, আরও বেশি ফলন বের করার। এ ধানের বীজ সংগ্রহ সহজ। কৃষকরা নিজেরাই তা করতে পারবেন। অন্য ধানের মতো বীজতলায় রোপণের পর চারা তুলে চাষ করতে হয়।
|