[পর্ব-২]
বঙ্গবন্ধু নূরুল আমিন ব্যতিত আওয়ামীলীগের প্রার্থীদের শপথ পাঠ করালেন তার সাথে স্বতন্ত্র ও অন্যান্য দল থেকে যে পাঁচজন বিজয়ী হয়েছিলেন তারাও শপথ নিলেন। এই শপথ অনুষ্টান রেডিওতে প্রচার করা হয়। তারিখটা আমার মনে নেই।
পাকিস্তানীদের টালবাহনা দেখে কারো বুঝতে বাকি রইলনো এরা সহজে ক্ষমতা দিবেনা বাঙ্গালীদের। এভাবে চলতে থাকে আলোচনা। দেশের মানুষ ভাবতে শুরু করলো হয়তোবা দেশে একটি রক্ষক্ষীয় যুদ্ধ হতে পারে। এই চিন্তা সকলের কেউ কেউ বাজার সওদা মওজুদ করতে লাগলো। গ্রামে গঞ্জে সাধারন মানুষের মাঝে অনেক কুসংস্কার আছে। তখন বয়স্ক অনেককেই বলতে শুনেছি দেশে বড় ধরনের একটি রক্তক্ষয় হতে পারে। তারা আলাতম হিসেবে বলতেন, দেখ পশ্চিম আকাশে লাল হয়ে সূর্জ ডুবেছে। আর কেউ বলতেন দেখ খাল-বিল-নদী নালার পানিতে লাল গেউর জমেছে। এটি নাকি রক্তপাতের লক্ষন। তাদের এজাতীয় ভবিষ্যৎ বানী সঠিক ছিল।
আমি সিলেট শহরে মডেল স্কুলে পড়ি বাবা প্রতিদিন বলতেন চলে যাও। মা এবং অন্যান্যরা বলতেন দেখ দেশের অবস্থা কোন দিকে গড়ায় তার পরে না হয় যাওয়া যাবে। এভাবে চলে দিন। আমার আরেকটা শখ ছিল পলবাওয়া, (পলবাওয়া মানে পল দিয়ে মাছ ধরা।) আমাদের গ্রামে মাঘ মাসের শেষ দিকে চাওখা বিলে পল দিয়ে মাছ ধরা হয়, আমার ইচ্ছে পলবাওয়া শেষ হলে যাব কেননা ক্লাস শুরু হতে সময় আছে। কিছু বাদ পরলে পুষিয়ে নেব।
চলে আসল মার্চের সাত তারিখ, যেহেতু পাকিস্তানীরা ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহনা করছে কারো বুঝতে বাকী রইলনা যে বাঙ্গালীদের বিকল্প উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এখানে আরেকটি কথা বলতে ভূলে গিয়েছি ৭০এর নির্বাচনের পরপরই প্রতিদিন ঢাকা রেডিও থেকে দেশাত্মবোধক গান বাজানো হত। ’’শোন শোন লোকে বলে শোন যত খাটি আমার বাংলাদেশের মাটি’’ জয় বালা বাংলার জয় ইত্যাদি গান। ‘’ তখনকার সময় গ্রামাঞ্চলে টেলিভিশন ছিলনা এমনকি সকল বাড়ীতে রেডিও ছিলনা। আমাদের পরিবারটি সচেতন আমার বাবা-চাচারা নিয়মিত রেডিও শোনতেন এমনকি পত্রিকা পড়তেন পত্রিকা আসত ডাকে, দৈনিক আজাদ এবং ইত্তেফাক আসত আমাদের বাড়ীতে। রেডিও নিয়ে সকলে বসলেন আমাদের বাংলোতে বঙ্গবন্ধুর ভাষন সরাসরি প্রচার করা হবে। দুর্ভাগ্য বসত ওইদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ঢাকা রেডিও থেকে প্রচার করা হলো না। প্রচার করা হল পরদিন অর্থাৎ ৮ মার্চ সকালে। সকলেই ধারনা করেছিলেন হয়তো বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষনা দেবেন। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সুকৌশলে স্বাধীনতার ঘোষনা দিলেন। তিনি বললেন এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম , এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, জয় বাংলা।
আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তুমাদের যার যা কিছু আছে তা নিয়ে রুখে দাড়াও শত্রুর মোকাবেলা কর। প্রতিটি পাড়ায় মহল্লায় আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তোল। বাঙ্গালী নন বাঙ্গালী সকলেই আমাদের ভাই। এর পর দিন থেকেই গ্রামে গঞ্জে শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। আনসার সদস্য এবং সাবেক সেনা সদস্যরা গ্রামে গঞ্জে ট্রেনিং শুরু করলেন। আগেই বলেছি বঙ্গবন্ধু ছিলেন হ্যামিলনের বংশীওয়ালা্- গ্রামের কৃষক-শ্রমিক,জেলে. নৌকার মাঝি সকলেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ল। যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তাদের অনেকেই জাতির পিতাকে স্বচক্ষে দেখেনি। কেননা সেসময় সকলের বাড়ীতে টেলিভিশন ছিলনা, গ্রামেত দূরের কথা শহরেও টেলিভিশন ছিল হাতগোনা কয়েকটি বাড়িতে। বঙ্গবন্ধুর কথায়তৎকালীন বাঙ্গালীদের যারা আনসার-পুলিশ , সেনাবাহিনী বা অন্যান্য বিভাগে সরকারী চাকুরী করতেন তাদের ৯৯% ই ছিল বঙ্গবন্ধুর অনুসারী। জেলে জাল নিয়ে মাছ ধরতে যায়নি, চাষী লাঙ্গল চালায়নি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতো পূর্ববাংলা। দিন যত ঘনিয়ে আসলো মানুষের উদবেগ আর উৎকণ্টা বাড়তে থাকে কি হচ্ছে এই চিন্তা আমাদের পরিবারের একটি অংশ তখন চাকুরী এবং ব্যবসার সুবাদে থাকতেন দেশের বিভিন্ন স্থানে, চট্রগামেই ছিলেন বেশী।
তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙ্গালী অফিসাররা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যুদ্ধের জন্য ভেতরে ভেতরে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। তখন আমাদের চাচাত ভাই গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী পাকিস্তান আর্মির সিগন্যাল কোরে ঢাকা সেনা নিবাসে কর্মরত| বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণে অত্যন্ত কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষনা দিলেন।Ôএবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম । আমি যতি হুকুম দিবার না-ও পারি তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে রুখে দাড়াও শত্রুর মোকাবেলা কর। Õএর পর থেকে দেশের অভ্যন্তরে সাধারণ মানুষ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ১৯৭১এর মার্চ মাসের ১৫ তারিখ স্ত্রী সন্তানকে কেন্টনমেন্টে রেখে লাপাত্তা হয়ে যান| ১৮ মার্চ ঢাকা সেনা নিবাস থেকে গ্রামের বাড়িতে তার ভাই মরতুজা আহমদ চৌধুরীর নামে একটি টেলিগ্রাম আসে গিয়াস আহত । তিনি যেন টেলিগ্রাম পাওয়ার ৪৮ঘণ্টার ভেতর মার্শাল ‘ল‘ অ্যডমিনিষটেটর টিক্কা খানের সাথে দেখা করেন। তখন সবার মাঝে আতঙ্ক দেশ কোন দিকে যাচ্ছে। তার ভাই মোরতজা আহমদ চৌধুরী ঢাকায় গেলে তাকে আটক করে টিক্কা খান। ২৫শে মার্চ পাকবাহিনী দেশের নীরিহ মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। এর ভেতর তার ভাতিজা মনির গিয়স উদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী খালেদা চৌধুরী ও শিশু কন্যা লাকিকে নিয়ে সেনা নিবাস থেকে পালিয়ে আসেন। তারাও ১২দিন পায়ে হেটে যুদ্ধের ভেতর ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরেন। মোরতজা আহমদ চৌধুরী জল্লাদ টিক্কা খানের কাছ থেকে কোন ক্রমে পালিয়ে আসেন।
২৫তারিখ রাত ১২টায় বঙ্গবন্ধু ইপিআরের ওয়ারলেস মারফত স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়ে বাসায় অবস্থান করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। পাকিস্তান রেডিও থেকে বলা হয় বঙ্গবন্ধুকে এরেষ্ট করা হয়েছে। পাকিস্তান বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের ভেতর শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। অন্যদিকে আকাশবাণী কলকাতা থেকে বার বার ঘোষনা করা হয় বঙ্গবন্ধু মুক্ত আছেন। আকাশ বাণী থেকে এসব প্রচারের অন্য কারণ ছিল যাতে সাধারণ মানুষের মনোবল না ভাঙ্গে।