এক সময় ছিল যখন পিড়ামিডের পেপিরাস পাতা কিংবা দেওয়ালে অঙ্কিত ছবির ভাষা গবেষকরা বুঝতেনই না। বেশ কয়েক যুগ গিয়েছে, নিরলস গবেষণার ভেতর দিয়ে মানুষ বুঝতে পেরেছে পিড়ামিডের ছবির সেই ভাষা। এখন আর সে ভাষা বুঝতে দুশ্চিন্তায় পড়তে হয় না। বইপড়ার মত ছবি দেখেই গবেষকরা বলতে পারেন পাপিরাস পাতায় কিংবা দেয়ালে কি লিখা।
রাজা জোসের-এর সৌধ দেয়াল গাত্রের সে ছবি পাঠ করে গবেষকরা জানতে পেরেছেন সৌধের নাম, তার কারিগরের নাম। আরো কত কি!
‘ইমোটেপ’ দেয়াল গাত্রের ছবি থেকে উদ্ধার করা তেমনি একটি নাম। এই ‘ইমোটেপ’ ছিলেন একাধারে দুই হাজার সাতশ’ বছর আগের একজন ডাক্তার, ধর্মযাজক ও ভাস্কর। দেয়াল অঙ্কন থেকে পাঠোদ্ধার করা আরো বহু নামের সনদ ও মেধাবীদের নামের মধ্যে এই ‘ইমোটেপ’কে বলা হয়েছে জোসের রাজার সৌধের স্থপতি।
এখনও সে পিড়ামিডের ভেতরে ঢুকা হয়নি। রয়েছে বলতে গেলে সম্পূর্ণটাই অনাবিষ্কৃত। রাজা জোসের মমির উপর নির্মিত সেই সমাধি বা স্মৃতিস্তম্ভ এখন বিশ্বের সবচেয়ে অক্ষত সমাধিসৌধ। বর্তমানে এর বয়স দাঁড়িয়েছে ৪হাজার ৭শত বছর।
রাজা জোসের’এর এই সমাধি সৌধটি নির্মাণ করা হয় খৃষ্ট জন্মের আগে ২৬৩০-২৬১১ অব্দ সময়ে। মিশরের সাক্কারা নামক স্থানে এটি আজো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। গবেষকরা দেখেছেন জোসের রাজের এই সৌধটি সারাটাই বিশালাকৃতির পাথর দিয়ে তৈরী। ১৯৭ফুট উঁচু এ পিড়ামিড নির্মাণ করতে ১১.৬ মিলিয়ন কিউবিক ফুট পাথর ও কাদা ব্যবহার করা হয়েছিল। মূলতঃ এ সৌধটির নক্সা তৈরী করা হয়েছিল প্রথা হিসেবে চলে আসা সাধারণ নমুনার সমতল ছাদদিয়ে ঢাকা একটি সৌধের নমুনায় যাকে মিশরীয় ভাষায় বলা হয় ‘মাস্তাবা’। কিন্তু রাজা জোসের চাইলেন আরো বড়, সবচাইতে বড় একটা কিছু। রাজার চাওয়া আর হুকুমতো একই কথা। আর সে কি যে সে রাজা। মানবেতিহাসের প্রথম রাজ-রাজড়া। যাদের হুঙ্কারে সে সময়ের দুনিয়া ভূকম্পনের মত কেঁপে কেঁপে উঠতো। ফলে স্থপতি ‘ইমোটেপ’ প্রচলিত প্রথার সৌধ নক্সা একপাশে রেখে দিলেন। তারও মনে নবআবিষ্কারের নেশা উঁকি দিল। শুরু হল নবোদ্দোমে কাজ। রাজা জোসের-এর ১৯ বছর মেয়াদের রাজত্বে সেই সৌধের নক্সা পরিবর্ধন করে আধুনিক সিড়ির নমুনায় ছয় স্তরে বিন্যস্ত করা হলো। যার উচ্চতা সে সময়ের সকল সৌধের উচ্চতাকে হারিয়ে দিয়ে উপরে মাথা উঁচু করে সেই যে দাঁড়িয়েছিল আজো তার বিশ্বজয়ের কথা মানব সভ্যতাকে জানান দিয়ে যাচ্ছে। এই ছয় সিড়ির সৌধ সে সময়ের জন্য এক শ্রেষ্ঠ নিপুণ স্থাপত্য শিল্পের অগ্রগতির নিদর্শন ছিল। রাজা জোসের-এর এই সৌধটি আসলে ৪০একর ভূমির উপর একটি বৃহৎ উঠান, বিভিন্ন ভজনালয়, ঠাকুর ঘর সম্বলিত এক বিশাল জঠিল উপাসনালয় হিসেবে নির্মাণ করা হয়। এর সমূহটা ৩০ফুট দেয়াল দিয়ে ঘেরা। বিশাল এই চত্তরে প্রবেশ পথ সহ দেয়ালের বিভিন্ন জায়গায় ১৩টি মেকি ফটক নির্মাণ করে রাখা হয়। চত্ত্বরের ভেতরে বিভিন্ন খোলা দালান আছে যা দেখলে বুঝা যায় এগুলো ছিল ভজন-কীর্তণের জন্য। ফারাহ বা রাজার কবর প্রকোষ্ঠ পিড়ামিডের মধ্যখানে খুব গভীরে তার ১১ কন্যার মমিসহ রাখা আছে। কবর প্রকোষ্ঠ, পিড়ামিডের গোলকধাঁধা সৃষ্টিকারী কুণ্ডলাকৃতির নালাদ্বারা পরিবেষ্টিত। গবেষকদের ধারণা, এ নমুনার নির্মাণ শৈলী ব্যবহার করা হয়েছে বাহিরের চুরি রোধ করতে। যদিও পিড়ামিডটি চুরি হয়েছে অনেক আগেই। দুঃখজনকভাবে, সুরক্ষনের এই নালাগুলির ক্ষয় হয়ে যাওয়া সম্ভবতঃ পিড়ামিডের ক্ষয় হয়ে যাবার কারণ বলে গবেষকদের ধারণা। অভিজ্ঞরা মনে করেন দেরী না করে ৩.৫ মাইল লম্বা এ নালাগুলি সঠিকভাবে সংস্কার না করা হলে ঐতিহাসিক পিরামিডটি ভেঙ্গে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। পিরামিডটি সুরক্ষার চলমান কাজ বর্তমানে বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। যে একটি কোম্পানীকে সংরক্ষন সংস্কারের দায়ীত্ব দেয়া হয়েছে তারা উল্টো কাজ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, সংরক্ষন সংস্কার কাজের নমুনাই পিরামিডের ক্ষতিসাধন করছে। বর্তমানের সংরক্ষন ও সংস্কার কাজ চলার জন্য জনসাধারণের সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। দর্শকরা সেখানে গিয়ে দাড়িয়ে থাকে। আকুল মন নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে দেখতে চায় ইতিহাসেরও অতীত মিশরীয় বাদশাহ্ দের অমর কীর্তি যা মিশরের স্থাপত্য ইতিহাসকে বিশ্বমানুষের কাছে আজো বিষ্ময়কর করে রেখেছে। তথ্যসূত্র: এটলাস অবস্কোরা থেকে অনুদিত। অনুবাদক: হারুনূর রশীদ।