হারুনূর রশীদ।।
বিষয়টি কিছুটা পুরানো হয়ে গেছে। আমাদের দেশীয় জীবন ব্যবস্থায়তো অভাব-অভিযোগের শেষ নেই। নিত্য নতুন সংকট একটা না একটা হাজির হবেই। সে অবস্থায় নতুন নতুন সংকট সমস্যা নিয়ে লিখেও কুলানো যায় না। সেখানে পুরানো বিষয় নিয়ে লিখা খুব একটা নিষ্ঠার পরিচয় নয়। তবে এই আমাদের সমাজেই কিছু কিছু সমস্যা আছে যা পুরানো হয়ে গেলেও তার ক্ষত দীর্ঘকাল তাজা থেকে ব্যক্তি, মানুষ ও সমাজ সকলকে ভুগায়। বহুতর সমস্যা আছে, যার ক্ষত বাড়তে বাড়তে দগদগে ঘা হয়ে পুরো সমাজের জন্য সংকট হয়ে উঠে। আরো এমন কিছু সমস্যা আছে আমাদের যা কোনদিনই একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায় না। থেমে থেমেই সময় সুযোগে মাথা তুলে দাঁড়ায়।
ভেজাল আর নকল। আমাদের সমাজে একে অপরের সাথে গা জড়াজড়ি করে চলে আসছে। ভেজাল আমাদের এমনই সর্বব্যাপী যে দেশী-বিদেশী কোন খদ্দেরই আমাদের উৎপাদিত বা তৈরী মালামালে একশতভাগ আস্তা রাখতে পারে না। আর নকল বিশেষ করে আমাদের সমাজ বা শিক্ষা ব্যবস্থায় ক্ষয় রোগের চেয়েও ভয়ানক। অতীতের সব সময় বাদ দিলেও শুধু একাত্তুরের স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে যদি ধরি তা’হলেওতো ৪৬ বছর হয়ে গেছে, আমরা আজও পারিনি ভেজাল আর নকলকে চিরবিদায় জানাতে। কেনো পারিনি আমরা এইটুকু বিষয়কে সমূলে উৎপাটন করতে! পারিনি এজন্যই যে আমাদেরই বেশ বড় এক অংশের মানুষ আমরা মনেপ্রানে চাইনা, এই অভিশপ্ত দুরন্ত নকল আর ভেজাল, জড় সহ উপড়ে ফেলা হোক।
এই ভেজাল আর নকলের কাজে মূলতঃ জড়িত কারা তাদের খবর সাধারণ মানুষ ভালকরেই অনুমান করতে পারে। কিন্তু যাদের জানার ও ব্যবস্থা নেয়ার কথা তাদের সাড়া-শব্দ এতই নিশ্তেজ যে এখন এগুলো মানুষের গা সওয়া হয়েগেছে। প্রতি বছরের মত এবারও রমজান আসার সাথে সাথেই নিত্যদিনের দরকারি জিনিষের দাম বেড়ে গেল। সংবাদ মাধ্যমে তার খবর আসলো। ওই পর্যন্তই। কারা দাম বাড়ায়, কেনো বাড়ায়? কি বিশেষ ব্যবস্থা নিলে দূর্নীতিপরায়নরা কোনদিন আর সেটি করতে পারবেনা, তেমন কোন বিহীত হতে আজও দেখিনি। স্বাধীনতা পরবর্তী ৪৬ বছর ধরে রোজা-পূঁজার মত বিশেষ বিশেষ সময়ে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের দাম বাড়বেই আর গণমাধ্যমে তা শুধু লিখাই হবে। এটি নিয়মের মত হয়ে গেছে। অথচ প্রয়োজনের তুলনায় উৎপাদন যদি কমই হয় তা’হলেও সময়ের আগেভাগেই আমদানী করে বাজারে মাল মওজুদ রেখে সঠিক সময়ে বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ রাখলে দাম যে ইচ্ছেমত বাড়ানো যাবে না তা আমরা সকলেই বুঝি। কিন্তু ওই কাজটি আমরা করিনা।
পরীক্ষার ক্ষেত্রে নকলের বেলায়ও একই অবস্থা। নকলকে আমরা ত্যাগ করতে পারিনি। বরং আরো বেড়েছে। আশ্চর্যের কথা হলেও এখন অনেক অভিবাবককেই ছেলে-মেয়ের জন্য নকল সরবরাহে এগিয়ে আসতে দেখি। আমাদের অনেক পরিচিতজনদের যেমন ভেজালের বিষয়ে অনেকটা উদাসীন দেখা যায় তেমনি নকল ব্যবহারে বা সরবরাহে যুক্ত হতে তাদের সামান্যতম অপরাধবোধে ভুগতে দেখিনা। তেমনি, বলতে গেলে আমরা প্রায় সকলেই এ ধরনের কাজকে নিজেদের আপনজনের প্রতি সামান্য সহায়তা মনে করি। কখনও মনে করি না এটি অনেক বড় মাপের একটি অপরাধ। আমাদের চেতনায় কাজ করে, আপনজনের জন্য একটা উপকার করে দেয়া।
আমাদের দেশে এ মানসিকতার আঁতুরঘর হলো সমাজের উপরতলা। আমাদের কানুন তাদের উপর খরগ তুলতে পারেনা। ওখানে যারা বাস করেন তাদের সবকিছু আছে। আপনজন বা সন্তানের জন্য শুধু প্রয়োজন একখানা সনদ। সনদ থাকলেই হলো। ব্যবসাতো নিজেদের আছেই। সুতরাং বাহির থেকে কর্মচারী নেয়ার আর প্রয়োজন হবে না। উপরের দেখা-দেখি নিচের দিকেও অবস্থা একই হতে বাধ্য। একখানা মাত্র সনদের জন্য নিজের একজনকে কাজ দিতে পারবো না! এতো হয় না। অতএব যেভাবে হোক একটা সনদ জোগার করে নিলেই হলো।
ব্যতিক্রম দুনিয়ার সকল সমাজেই আছে। কিন্তু ব্যতিক্রম দিয়ে সমাজ, রাষ্ট্র বা দেশ চলে না।
কেনো এমন হয় সমাজের উপরতলায়! দুনিয়ার কোন মানুষইতো মুখে-পিটে খারাপের সনদ নিয়ে জন্মায় না। মাটিতে ভুমিষ্ট হবার পর ধীরে ধীরে সে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়। যে ঘরে জ্ঞানের চর্চ্চা নেই, নেই জ্ঞানের প্রতি মর্যাদা, জ্ঞানের চেয়ে সম্পদের বিষয়টি যাদের কাছে প্রণিধানযোগ্য; যাদের কাছে সম্পদ বলতে অর্থই প্রধান, তার উৎস নয়। তেমন ঘরানায়ই এমন মানসিকতা লালিত পালিত হয় বেশী। আর উপর তলা থেকে নিচের দিকে গড়িয়ে গিয়ে গোটা সমাজকে কলুষিত করার কাজ, কেবল মাত্র ওই উঁচু তলার মানুষগুলোর পক্ষেই সম্ভব।
সদ্দ্বিচ্ছা থাকলে, খাদ্য সামগ্রীতে বিভিন্ন নমুনার ভেজাল মেশানোর কাজ হয়তো কিছুটা হলেও কমিয়ে আনা সম্ভব কিন্তু পরীক্ষায় নকল বন্ধ বেশ জঠিল, শিক্ষা নিয়ে চিন্তাভাবনা ও গবেষণার কাজ এটি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমাদের দুই পদ্বতির শিক্ষা ব্যবস্থাকে একটি পদ্বতিতে নিয়ে আসতেই হবে। আমাদের জঙ্গি বাদে দীক্ষার মূলে রয়েছে এই বিভক্ত শিক্ষা পদ্বতি। আরবী শিক্ষা পদ্বতি আমাদের বাস্তব জীবনে নামাজ-দোয়ার নামে ঘরে বসে বসে খাওয়া ছাড়া কোন কাজে আসার নয়। ইংরেজীর মত আরবীও আমাদের কাছে একটি বিদেশী ভাষা। ইংরেজীর মত বেশী বেশী করে আরবী বিষয়ও বাংলায় অনুবাদ করে বাংলাতেই পড়াতে হবে। শুধুমাত্র আরবী ভাষার একটি বিষয় থাকতে পারে, যারা আরবী ভাষা শিখতে চায় তাদের জন্য। এতে করে আমাদের অন্ধের আনুগত্যকে বিদেয় করা সম্ভব। এ বিষয়ে সবিশেষ বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।