স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও কৃষকের স্বার্থে যতটুকু করা প্রয়োজন কোন সরকারই তা করতে পারেনি। বছর বছর বাজেটের আকার বাড়লেও কৃষিক্ষেত্রে বরাদ্দ কচ্ছপ গতিতেই বাড়ে! এরপরও প্রতি বছর বাজেটে যেটুকু বরাদ্দ হয়, সেটুকু সঠিক ভাবে বাস্তবায়ন হয় না। ভর্তুকি এবং কৃষি ঋণ তো ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের ভাগ্যে জুটে না। প্রান্তিক কৃষকেরা ঋণের জন্য ব্যাংকের দুয়ারে হাটতে হাটতে ব্যর্থ হয় কিন্তু বর্গাচাষীদের দেখিয়ে ঋণ নিতে সক্ষম হয় সচ্ছল ব্যক্তি! অন্যদিকে সিন্ডিকেট এবং মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে দেশের কৃষকেরা অসহায়। একটি কার্যকরী পণ্য বিপণন ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় প্রতি বছর হাজার হাজার কৃষক উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে নিজ জমির কষ্টের ফসল আগুন দিয়ে জ্বালায় অভিমানী কৃষক! ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দুগ্ধ খামারিরা রাগে-দুঃখে রাস্তায় দুধ ঢেলে প্রতিবাদ জানায়! তারপরও নির্বিকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ!
যে কৃষক বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বনির্ভর করেছে, তাঁর দূর্দশা কখনোই দূর হয় না। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুতও বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু হাতেগোনা ধনী কৃষক ব্যতীত প্রান্তিক কৃষকদের কোনো উন্নতিই হচ্ছে না। আমাদের দেশে অনেক আগেই কৃষিতে বিপ্লব হয়ে গেছে, ফলনও বেড়েছে কয়েকগুণ। কিন্তু কৃষকের জীবনমানের উন্নতি ঘটেনি। অথচ কৃষকেরাই দেশের সবচেয়ে বড় যোদ্ধা। যারা নিজেদের খাবার যোগায়, যোগায় বাকিদের খাবার! প্রান্তিক এই মানুষগুলোর তেমন কোন চাওয়া-পাওয়া নেই। তাঁদের চাওয়াটুকু শুধু কোন মতে একমুঠো ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকা।
প্রতি বছর বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরও দেশকে খাদ্যের যোগান দিয়ে যাচ্ছেন। সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কারণেও পুকুরের মাছ, চিংড়ি ঘের, হাস-মুরগীর খামার ব্যাপক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
করোনা ভাইরাসের কারণে বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানিগুলো যখন কর্মী ছাটাই করা শুরু করল, তখন কর্মহীন মানুষগুলো কৃষিকেই বাঁচার অবলম্বন হিসেবে নিয়েছে। শাক-সবজি চাষ বা কৃষি ক্ষেতে মজুরি করা, যে যেভাবে পারছে বাপ-দাদার আদি পেশায় লেগে গেছে। মনে রাখতে হবে একজন কৃষক বা খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাঁকে পথে বসতে হয়, ছেলে-মেয়েদের নিয়ে না খেয়ে থাকতে হয়! তাই মৎস্য, পশুপালন, পোলট্রি ফার্ম, দুগ্ধ খামার অথবা সাধারণ চাষিই হোক এদের যাঁরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাঁদের পাশে রাষ্ট্রকে দাঁড়াতে হবে। অন্যথায় দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণকারী যোদ্ধারা হাল ছেড়ে দিবে! আর তখন গোটা রাষ্ট্রের নাগরিকেই কঠিন পরিস্থিতি মুকাবিলা করতে হবে!
কয়েকটি লক্ষনীয় বিষয়-
১. কৃষি খাতের ভর্তুকির সুফল প্রান্তিক বা দরিদ্র কৃষকেরা পান না।
২. কৃষি ঋণের নীতিমালা বড় এবং ধনী কৃষকদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।
৩. কৃষকের জন্য শস্যবীমা কী কারণে আটকে আছে? তা বোধগম্য নয়!
৪. কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হলেও মধ্যস্বত্বভোগীর লাভের বিষয়টি ঠিকই আগলে রাখা হচ্ছে!
৫. সিন্ডিকেটের কারণে গত বছর আলু ৫০- ৬০ টাকায় বিক্রি হলো আর এবার কৃষক মাঠ পর্যায়ে ৫ টাকা দরে বিক্রি করতে পারলো না!
বাজেট প্রনয়নে আমলাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তাই বাজেটে আমলারা তাঁদের স্বার্থকেই বেশি প্রাধান্য দেন। সুতরাং কৃত্রিম বাতাসে বেড়ে ওঠা বড়কর্তারা রোদেপুড়া মানুষের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হবে না। কিন্তু যারা জনগণের প্রতিনিধি হয়ে মহান সংসদে আছেন, তাঁরা তো বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিষয়ে উদাসীন থাকার কথা নয়! হাওরের মধ্যখানে ক্ষেতের আলে নিথর দেহে পড়ে থাকা কৃষকের ছবিটি কি তাঁদের চোখে ভাসে না?
কবি বলেছিলেন-
ব্রত তাহার পরের হিত, সুখ নাহি চায় নিজে,
রৌদ্র দাহে শুকায় তনু, মেঘের জলে ভিজে।
আমার দেশের মাটির ছেলে, নমি বারংবার
তোমায় দেখে চূর্ণ হউক সবার অহংকার।
কৃষকেরা সংগঠিত নয় বলে তাঁদেরকে দোষারোপ না করে, বরং কারা কৃষকদের সংগঠিত হতে দেয় না, সেটি বের করতে হবে। আমাদের দেশে কৃষকের নামে অনেক সংগঠন আছে কিন্তু কেউই কৃষকের অধিকার নিয়ে শক্ত অবস্থান নিতে পারছেন না। বড় বড় রাজনৈতিক দলেও সহযোগী সংগঠন হিসেবে কৃষক সংগঠন আছে কিন্তু বাস্তবতা হলো বামপন্থী কিছু সংগঠন ছাড়া আর কেউ কৃষকের স্বার্থে কথাই বলতে চান না! কৃষকের অধিকার নিয়ে অল্প কিছু কাজ করার সুবাদে দেখেছি যে, স্বার্থান্বেষী মহল কী করে একটি ন্যায্য আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে এর পেছনে লেগে যায়। কৃষিপ্রদান দেশগুলো ব্যতীত বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্র যখন করোনার আক্রমণে দিশেহারা, তখনো যে আমরা টিকে আছি, তা কোন জাদুর বলে তা কি মাথায় আসে না? করোনা আবারও প্রমাণ করেছে যে কৃষিই আমাদের সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি। এখনো আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কৃষির সাথে জড়িত। তাই কৃষিখাতকে উপেক্ষা করে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।
লেখকঃ সংগঠক ও সংবাদকর্মী।
|