মুক্তকথা: রোববার ১৮ই অগ্রহায়ন ১৪২৩।।
পর্যটন জেলা মৌলভীবাজারের প্রধান দর্শনীয় স্থান লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। গহীন অরন্যে উদ্যানের বনের ভেতর থেকে চোখের পলকে সাপ, সিংহ, বাঘসহ শত রকমের পাখি দেখতে ভ্রমন পিপাসু মানুষ ছুটে আসে এই অরন্যে। কিন্তু এখন সংকটে ‘লাউয়াছড়া’ জাতীয় উদ্যানের জীববৈচিত্র্য।
সংরক্ষিত এই বনটির নেই সেই জৌলুস। মানবসৃষ্ট সংকটে ঐতিহ্য ধরে রাখতে হিমশিম খাওয়া এই উদ্যানটি এখন অনেকটাই ধ্বংসের দোর গোড়ায়। ওখানকার চলমান সংকটের তালিকা প্রতিনিয়তই দীর্ঘ হচ্ছে। কিন্তু চলমান এ সংকট নিরসনে নেই কোনো মহাপরিকল্পনা কিংবা স্থায়ী উদ্যোগ। নানা কারণে দীর্ঘদিনের বয়ে চলা সংকটগুলো ঘনীভূত হয়ে এখন মহা হুমকিতে পড়েছে ওখানকার নানা দুর্লভ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর বাসস্থান, জীবন জীবিকা ও পরিবেশ। প্রতিনিয়তই খাদ্য, নিরাপদে অবাদ বিচরণ ও বাসস্থানের আয়তন ছোট হচ্ছে ওই সকল বন্য প্রাণীদের। আর এ কারণেই দিন দিন পরিসংখ্যানও কমছে ওখানে ঠাঁই নেয়া বিশ্বের বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণী, উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া রেল লাইন। এখানে প্রতিদিনই কোন না কোন প্রাণী প্রান হারায়।
এ সংকট উত্তরণে (মাঠ জরিপ ও সমীক্ষা শেষে) সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা নানা পরামর্শ দিলেও তা আমলে নিচ্ছেন না কর্তৃপক্ষ। লোক দেখানো দায়সারা গোচের দু’একটি কর্মসূচি পালন করেই তারা ক্লান্ত।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এমন উদাসীনতায় বিলীনের পথে ওখানকার জীববৈচিত্র্য ও বনজসম্পদ। বিশ্বের বিলুপ্ত প্রায় উল্লুকসহ বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণী, উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানটির জীববৈচিত্র্য এখন চরম সংকটে। এর অন্যতম কারণ উদ্যানটির সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ফলজ ও বনজ গাছ চুরি, বাঁশ চুরি, ভূমি বেদখল, গ্যাস কূপ খনন, বন্যপ্রাণীর খাবার, আবাসস্থল ও অবাধ বিচরণের জায়গা কমে যাওয়া, শুষ্ক মৌসুমে খাবার পানির সংকট। উদ্যানের ভেতর দিয়ে রেল ও সড়কপথ থাকা। তাছাড়া লাউয়াছড়ার ভেতর দিয়ে বৈদ্যুতিক তার ও খুঁটিও টানানো। যা বন্য প্রাণীদের চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় এবং প্রায়ই দুর্ঘটনায় প্রাণীগুলি মারাও যায়।
বনের ভেতরে চাষাবাদ, অত্যধিক পর্যটকের চিৎকার আর হৈ হুল্লোড়। যাতে বিব্রত ও ভীত হয়ে নিজেদের আবাস্থল ছেড়ে অন্যত্র সরতে চায় এ সকল নিরীহ বন্যপ্রাণী। এ সকল সমস্যা চলতে থাকায় সব মিলিয়ে এখন সংকটাপন্ন অবস্থা দেখা দিয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) আয়োজিত কমলগঞ্জে ‘লাউয়াছড়া বন’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় আলোচকদের আলোচনায়ও এসব তথ্য উঠে এসেছে। এই আলোচনায় অংশ নেন জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবীদ, সমাজকর্মী, সাংবাদিক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, পেশাজীবী, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, পরিবেশবিদ, ব্যবসায়ী, বন বিভাগের কর্মকর্তা ও স্থানীয় নানা শ্রেণিপেশার জনসাধারণ। তারা উদ্যানটির সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও বন্যপ্রাণী বাঁচিয়ে রাখতে বয়ে চলা সমস্যা গুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানে করণীয় সম্পর্কে তাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত তুলে ধরেন। মতবিনিময় কালে আলোচকরা লাউয়াছড়ায় বয়ে চলা নানা সমস্যাগুলো নিয়ে গুরুত্বসহকারে আলোচনা করেছেন।
আলোচকরা বলেন পূর্বের লাউয়াছড়ায় যে বন জঙ্গল ছিল সেটি এখন আর নেই। উদ্যানে ক্লোরোফর্ম গাছটিও নেই। নেই চন্দন, ক্লোরোফর্ম, আগর, সেগুন, চাপালিশসহ নানা প্রজাতির বৃহদাকার গাছ। প্রতিনিয়তই গাছ ও বাঁশ চুরি হয়ে বন ফাঁকা হচ্ছে। চুরি হওয়া গাছের সাক্ষী হয়ে থাকছে গাছের মোথাগুলো। গাছ চোরেরা অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করে গাছ চুরি অব্যাহত রাখলেও তাদের প্রতিহত করতে নেই সমন্বিত পদক্ষেপ কিংবা কলা কৌশল। বরং অস্ত্র ও পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব সংশ্লিষ্ট বিভাগের। তাই ওদের কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না উদ্যানটির ফলজ ও বনজ মূল্যবান গাছগুলো। যা জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় রাখছে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
তাছাড়া লাউয়াছড়া উদ্যানে খাসিয়া পুঞ্জির লোকজন বসবাস করছেন। তারা পান চাষের নামে ছোট বড় বনজ ও ফলজ গাছের অগ্রভাগ ও ডাল পালা কেটে গাছের জীবনচক্র নষ্ট করছেন। যেটি বন্যপ্রাণী ও বনের মারাত্মক ক্ষতি করছে। ট্রেন ও সড়কপথে গাড়ি চাপায় প্রায়ই মারা যাচ্ছে নানা বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণী। আলোচনায়, লাউয়াছড়া উদ্যানের পার্শ্ববর্তী বাসিন্দারা তাদের বক্তব্যে বলেন, বনে খাবার সংকটে রাতে শিয়াল, শূকর, বানর, হরিণসহ ওখানকার বনের বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী খাদ্যের সন্ধানে আশপাশের গ্রামগুলোতে আসে। অভুক্ত এ প্রাণীগুলো খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে এসে বিনষ্ট করে তাদের ক্ষেতের ধান ও সবজি। এ সময় অনেক প্রাণীও মানুষের হাতে মারাও যায়। এছাড়া ১৯৯৭ সালে মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণে গাছগাছালি মরে যাওয়ায় প্রকৃতির মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার বিষয়টিও উঠে আসে। আলোচকরা বলেন, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের বনে মানুষ আঘাত করছে। আর এ কারণেই ধ্বংস হচ্ছে ওখানকার জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতি।
মতবিনিময় সভায় আলোচকরা আরও বলেন এ সকল চিহ্নিত সমস্যা সমাধান করতে সংশ্লিষ্টদের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। তারা এ সকল বিষয়ে সমাধানে লাউয়াছড়াকে বাঁচিয়ে রাখতে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে ১২৫০ হেক্টর জায়গা নিয়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় জীববৈচিত্র্যময় বন গবেষণা কেন্দ্রসহ এই উদ্যানে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণীর বিচরণ। জানা যায়, লাউয়াছড়ায় ৪৬০ প্রজাতির জীববৈচিত্র্যের মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ছয় প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী এবং ১৭ প্রজাতির পোকামাকড় রয়েছে। নানা সমস্যা ও সংকটে ওখানকার প্রাণী ও জীববৈচিত্র্যগুলো এখন অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। এদের রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে কয়েক বছরের মধ্যেই বিলীন হবে এ জাতীয় উদ্যানটির সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বিশ্বখ্যাত বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য। তাই শিগগিরই সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে টনক নড়া উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।