সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পৌষ সংক্রান্তি উৎসব সোমবার। এ উৎসবে হিন্দু স¤প্রদায়ের ঘরে ঘরে তৈরী হবে নানা ধরনের পিঠা পুলি ও সুস্বাদু খাবার। তার একটি বড় অংশ হচ্ছে বাজার থেকে বড় আকারের মাছ কিনে খাবার তৈরী করা। তাই পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সীবাজার, শমশেরনগর, ভানুগাছ বাজার, আদমপুর বাজার ও শহীদ নগর বাজারে বসেছে বিরাট মাছের মেলা। রোববার (১৪ জাুনয়ারি) সকাল ১০টা থেকে বিভিন্ন জাতের বড় আকারের মাছ সাজিয়ে বসেন মাছ বিক্রেতারা। পৌষ পার্বন উপলক্ষে বড় আকর্ষণ থাকে বাজার থেকে পছন্দ মত বড় আকারের মাছ কিনে খাবার তৈরী করা।
রোববার দুপুরে ভানুগাছ বাজার, মুন্সীবাজার ও শমশেরনগরে মাছের বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি মাছের দোকানে সামান্য ছোট আকারের মাছ সাজিয়ে রাখা হলেও সংগ্রহে রাখা হয়েছে নানা জাতের বড় আকারের মাছ। চিতল, রুই, কাতল, মৃগেল, পাঙ্গাস, আইড়, ব্রিগেট, বাঘ মাছ, রুপ চাঁদা, ঘাস কার্পসহ নানা জাতের সামুদ্রিক মাছ। কিছু কিছু দুর্লভ মাছ যেগুলো সহজে হাট বাজারে পাওয়া যায় না এমন মাছও সাজিয়ে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে। বিক্রেতারাও বেশ চড়া দাম হাকালেও শেষ পর্যন্ত সহনীয় পর্যায়ের দামে মাছ বিক্রি করতে হচ্ছে।
মুন্সীবাজারে মাছের বাজারের আসা ক্রেতা সুশীল দেবনাথ, নুরুল মোহাইমীন ও সঞ্জয় দাশ জানান, এ উৎসবকে কেন্দ্র করে বাজারে নানা জাতের বড় আকারের মাছ উঠে। দাম বেশী হলেও পরে দরাদরি করে কিনে নিতে হয়। ভানুগাছ বাজারের মাছ বিক্রেতা ঝুলন, রাসেল, জাহাঙ্গীর, হাফিজ বলেন পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে প্রায় ৮ লক্ষ টাকার বিভিন্ন ধরনের মাছ সংগ্রহ করেছি। আমাদের সংগ্রহের মধ্যে ২২ কেজি ওজনের বোয়াল যার দাম হাকেন ৩৫ হাজার টাকা। ১২ কেজি ওজনের বাঘ মাছের দাম হাকেন ২৩ হাজার টাকা। বিলুপ্ত প্রজাতির ১০ কেজি ওজনের নানান মাছের দাম হাকেন ২৪ হাজার টাকা। তারা জানায়, দাম বড় কথা নয়। মূলত ক্রেতাদের আকর্ষিত করে এমন বড় আকারের মাছ সরবরাহ করা হয় মাছ মেলায়। যদিও বেশ চড়া দাম বলা হলেও ক্রেতারা দরাদরি করে পড়ে সহনীয় পর্যায়ে হলে কিনে নিচ্ছেন। আর পরিবহন ব্যয় ধরে সামান্য লাভ হাতে রেখেই অবশেষে দাম কমিয়ে মাছ বিক্রি করছেন তারা।
পতনঊষার ইউনিয়নের শহীদনগর বাজারের মাছ বিক্রেতা বকুল পাল ও অধন পাল বলেন, আমরা সব ধরনের মাছ নিয়ে এসেছি। মাছের মেলা উপলক্ষে সবাই কম বেশি মাছ কিনেন। মাছের দাম একটু বেশি থাকায় আমরাও কিছুটা দাম বেশি চাচ্ছি। এ বাজারে মাছ ক্রয় করতে আসা, শুকেস দেব, সুবহান মিয়া বলেন, পৌষ-সংক্রান্তি উৎসব উপলক্ষে প্রতি বছর মাছের মেলা বসে পুরো জেলা জুড়ে। মেলা উপলক্ষে বছরে একদিন বড়বড় বিভিন্ন জাতের মাছ দেখা যায়। যে যার মতো করে এক বাজার থেকে অন্য বাজার ঘুরে দাম দেখা মাছ ক্রয় করছেন। আমরাও মাছ ক্রয় করেছি। বাজারে মাছ দেখতো পরিবারের বাচ্চারাও এসেছে।
মাছের আড়ৎদার আব্দুল জলিল মিয়া বলেন, আগের চেয়ে এখন দেশীয় মাছের সরবরাহ অনেক কমে গেছে। সাধারনত বাজারে এত বড় আকারের মাছ উঠে না। পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে চাহিদা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হাওর, বাওর, বিল ও বড় নদী থেকে ধরে আনা বড় আকারের মাছ এ বিশেষ দিনের জন্য সরবরাহ করতে হয়। মাছের মেলায় রোববার গভীর রাত এমনকি সোমবার পর্যন্ত এ বিক্রয় চলবে বলে আড়ৎদার জানান।
মৌলভীবাজার ও সিলেটের প্রাচীন ঐতিহ্য পিঠে-পুলির অন্যতম চুঙ্গাপুড়া পিঠা বিলুপ্তপ্রায় হয়ে যাচ্ছে। আগের মতো এখন আর গ্রামীন এলাকার বাড়িতে বাড়িতে চুঙ্গাপুড়ার আয়োজন চোখে পড়ে না। শীতের রাতে খড়কুটো জ্বালিয়ে সারারাত চুঙ্গাপুড়ার দৃশ্যও তাই দেখা যায় না। এক সময় ছিলো বাজারে মাছের মেলাও বসতো। সেই মেলা থেকে মাছ কিনে কিংবা হাওর-নদীর হতে বড় বড় রুই, কাতলা, চিতল, বোয়াল, পাবদা, কই, মাগুর মাছ ধরে নিয়ে এসে হাল্কা মসলা দিয়ে ভেজে (আঞ্চলিক ভাষায় মাছ বিরান) দিয়ে চুঙ্গাপুড়া পিঠা খাওয়া ছিলো মৌলভীবাজার ও সিলেটের একটি অন্যতম ঐতিহ্য। বাড়িতে মেহমান বা নতুন জামাইকে শেষ পাতে চুঙ্গাপুড়া পিঠা মাছ বিরান আর নারিকেলের পিঠা বা রিসা পরিবেশন না করলে যেনো লজ্জায় মাথা কাটা যেতো। বর্তমানে সেই দিন আর নেই। চুঙ্গাপিঠা তৈরির প্রধান উপকরণ ঢলু বাঁশ ও বিন্নি ধানের চাল (বিরইন ধানের চাল) সরবরাহ এখন অনেক কমে গেছে। অনেক স্থানে এখন আর আগের মতো চাষাবাদ ও হয় না।
মৌলভীবাজারের বড়লেখার পাথরিয়া পাহাড়, জুড়ীর লাঠিটিলা, রাজনগরসহ বিভিন্ন উপজেলার টিলায় টিলায় ও চা-বাগানের টিলায়, কুলাউড়ার গাজীপুরের পাহাড় ও জুড়ী উপজেলার চুঙ্গাবাড়ীতে প্রচুর ঢলুবাঁশ পাওয়া যেতো। তন্মধ্যে চুঙ্গাবাড়ী ও এক সময় প্রসিদ্ধ ছিলো ঢলুবাঁশের জন্যে। অনেক আগেই বনদস্যু ও ভুমিদস্যু এবং পাহারখেকোদের কারনে বনাঞ্চল উজাড় হয়ে যাওয়ায় হারিয়ে গেছে ঢলুবাঁশ। তবে জেলার কিছু কিছু টিলায় এখন ও ঢলুবাঁশ পাওয়া যায়। পাহাড়ে বাঁশ নাই বলে বাজারে ঢলুবাঁশের দামও এখন তাই বেশ চড়া। ব্যবসায়ীরা দুরবর্তী এলাকা থেকে ঢলুবাঁশ ক্রয় করে নিয়ে যান নিজ নিজ উপজেলার বাজার সমুহে বিক্রির আশায়। বাঁশটি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া জরুরী। ঢলুবাঁশ ছাড়া চুঙ্গাপিঠা তৈরি করা যায় না কারন ঢলুবাঁশে এক ধরনের তৈলাক্ত রাসায়নিক পদার্থ আছে, যা আগুনে বাঁশের চুঙ্গাকে না পোড়াতে সাহায্য করে। ঢলুবাঁশে অত্যধিক রস থাকায় আগুনে না পুড়ে ভিতরের পিঠা আগুনের তাপে সিদ্ধ হয়। ঢলুবাঁশের চুঙ্গা দিয়ে ভিন্ন স্বাদের পিঠা তৈরি করা করা হয়ে থাকে। কোনো কোনো জায়গায় চুঙ্গার ভেতরে বিন্নি চাল, দুধ, চিনি, নারিকেল ও চালের গুড়া দিয়ে পিঠা তৈরি করা হয়। পিঠা তৈরি হয়ে গেলে মোমবাতির মতো চুঙ্গা থেকে পিঠা আলাদা হয়ে যায়। চুঙ্গাপিঠা পোড়াতে আবার প্রচুর পরিমানে খেড় (নেরা) দরকার পড়ে। খড়ও এখন সময়ের প্রয়োজনে দাম একটু বেশি।
একটা সময় ছিলো শীতের মৌসুমে গ্রামীণ জনপদে প্রায়ই বাজারে মাছের মেলা বসত, বিশেষ করে সনাতনী হিন্দু স¤প্রদায়ের অন্যতম উৎসব পৌষ সংক্রান্তির সময় এ বাঁশগুলো কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছ, আদমপুর, মুন্সীবাজারসহ বিভিন্ন হাটবাজারে দেখা গেছে।
কমলগঞ্জ উপজেলার পাহাড়ী এলাকায় প্রচুর ঢলুবাঁশ পাওয়া যেতো। তন্মধ্যে চুঙ্গাবাড়িও এক সময় প্রসিদ্ধ ছিলো ঢলুবাঁশের জন্যে। অনেক আগেই বনদস্যু ও ভুমিদস্যু এবং পাহাড়খেকোদের কারনে বনাঞ্চল উজাড় হয়ে যাওয়ায় হারিয়ে গেছে ঢলুবাঁশ। তবে জেলার কিছু কিছু টিলায় এখনও ঢলুবাঁশ পাওয়া যায়।
পিঠা তৈরী করার জন্য মুন্সীবাজারে ডলুবাঁশ নিতে আসা নিবাস চন্দ আব্দুল বাছিত খান বলেন, ‘আসলে সব সময় তো এই জিনিসগুলো পাওয়া যায় না। পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে এগুলো খুব কম পরিমান বাজারে উঠেছে। আজ থেকে ১০-১৫ বছর আগে প্রচুর দেখা যেতো। এখন কালের পরিবর্তনে হারিয়ে বসেছে। বাজার আসার সময় পরিবারের সদস্যরা বললো পিঠা তৈরি করার জন্য এই ঢলুবাঁশ পেলে নিয়ে যেতে, তাই কয়েকটা বাজারগুলো ঘুরে দেখলাম পাইনি এখন মুন্সীবাজারে স্বল্প পরিমান নিয়ে এসেছে এখন বিক্রেতা আমি সেখান থেকে নিয়ে যাচ্ছি বাসায়।’
কমলগঞ্জ উপজেলার লেখক-গবেষক ও উন্নয়ন চিন্তক আহমদ সিরাজ জানান, ‘আগে কম-বেশি সবার বাড়িতে ঢলু বাঁশ ছিল। এখন সেই বাঁশ আগের মতো নেই। এই বাঁশ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। একসময় এই ঢলুবাঁশ দিয়ে চুঙ্গাপুড়ার ধুম লেগেই থাকতো।’
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ সমাজকল্যাণ পরিষদের উদ্যোগে ও বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল, মৌলভীবাজার এর সার্বিক সহযোগিতায় কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নের নোয়াগাঁও তালিমুল কোরআন মাদ্রাসায় রোববার সকাল ৯টায় ২য় বারের মত ফ্রি চক্ষু ক্যাম্প অনুষ্টিত হয়। ক্যাম্পে বিনামূল্যে ঔষধ ও ছানি অপারেশনের কার্যক্রমের উদ্বোধন অনুষ্ঠিত হয়। রোববার (১৪ জানুয়ারি) দুপুরে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে দিনব্যাপী ফ্রি চক্ষু ক্যাম্পের উদ্বোধন করেন কমলগঞ্জ উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুল।
সমাজকল্যাণ পরিষদের সভাপতি ফাত্তাহুর রসিদ চৌধুরী মাহফুজ এর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক লুৎফুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, মাধবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আসিদ আলি, নোয়াগাঁও তালিমুল কোরআন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা নুরুল মোত্তাকিম জুনাইদ, শ্রীমঙ্গল নাজাত ইসলামি মার্কাসের নির্বাহী পরিচালক মাওলানা শফিউদ্দিন, সমাজ কল্যান পরিষদের পৃষ্ঠপোষক মাওলানা লুৎফর রহমান জাকারিয়া, সাংবাদিক আসহাবুজ্জামান শাওন, আলফালাহ ইসলামি যুব সোসাইটির সভাপতি খালেদ বীন শাওকী, কমলগঞ্জ সমাজকল্যান পরিষদের সহ-সভাপতি মাওলানা খালেদ আহমেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক আনিছুর রহমান, সহ-সাধারন সম্পাদক নাজমুল ইসলাম, কোষাধ্যক্ষ মাওলানা সামছুল ইসলাম, দপ্তর সম্পাদক মাওলানা হোসাইন আহমেদ প্রমুখ।
চক্ষু শিবিরের কার্যক্রম শেষে বিকাল ৩টায় বিনামূল্যে চোখের ছানি অপারেশন যোগ্য প্রায় ৩৮ জন রোগিকে বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল মৌলভীবাজারে প্রেরণ করা হয়। অপারেশন পরবর্তী পরিচর্যা শেষে তাদের নিজ নিজ বাসস্থানে পৌছে দেয়া হবে জানান পরিষদের সদস্যরা।