বিশ্ব রাজনীতি নিয়ন্ত্রণকারীদের মুণ্ডু ঘুরিয়ে দেয়ার মত কাজ করেছে দুই কোরিয়া। যদি না এটা তাদেরই পাতানো কোন নতুন দূরভিসন্ধি না হয়ে থাকে। দুই কোরিয়ার এ বন্ধুত্ব একদিকে যেমন দুনিয়ায় নতুন এক যুগ সন্ধিক্ষনের ইঙ্গিত দেয় ঠিক তেমনি ইঙ্গিত দেয় বিশ্ব রাজনীতির নমুনা ও নেতৃত্ব বদলের।
দুই কোরিয়ার অর্থনীতি আর রাজনীতির সাথে দুনিয়ার দুই দিকপাল মার্কিন ও রুশীয়রা আছেন। উত্তর কোরিয়ার সাথে অনেক পরে হলেও চীনারাও আছেন। এখন বুঝার বিষয় আসলেই দুই কোরিয়া নিজেদের সুদীর্ঘ কালের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে এক হতে চাচ্ছে না-কি এখানেও বড় বড় শক্তিমানদের কোন দূরোভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা কাজ করছে। নিশ্চয়ই বিশ্ব রাজনীতির পর্যবেক্ষক ও গবেষকগন এনিয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছেন এবং আজ হোক কাল হোক আমরা কিছু জানতে পারবো।
অবশ্য বিভাজিত কোরিয়দের একিভূত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা আজ নতুন কিছু নয়। একই দেশ, একই মাটি ও মানুষ, একই ভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে দু’ভাগ হয়ে থাকার কোন কারণ ছিল না। একমাত্র বিশ্বরাজনীতি ও তার মোড়ল রুশ-মার্কিন ও চীনাদের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষাই তাদের প্রায় ৬৪ বছরের মত সুদীর্ঘকাল ধরে দুই ভাগ করে যুদ্ধে লাগিয়ে রেখেছে। একইভাবে রুশ-মার্কিনীরা জার্মানীকে দুই ভাগ করে রেখেছিল। প্রায় ৫০ বছরের মত সময় লেগেছিল জার্মানীর মাথা তুলে দাঁড়াতে। এখনও ভারতের পাঞ্জাব ও বাংলা দুইভাগে ভাগ হয়ে আছে। এই ভাগের পেছনেও ইং-মার্কিন স্বার্থ। বাংলাদেশতো স্বাধীন দেশ হয়ে একইভূত হওয়া থেকে অনেক অনেক দূর অবস্থান করছে।
এই সব বিভাজনই বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির গুরুদের বিচার।
দুনিয়াকে এভাবে বিভাজিত করে যুদ্ধে লাগিয়ে রেখে তারা কিন্তু তাদের লণ্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, মস্কো বা বেইজিং ঠিকই নির্বিঘ্ন নিরুপদ্রবে গড়ে তুলেছেন। ইংরেজগন তাদের দেশে আজও রাজতন্ত্র টিকিয়ে রেখেছে। তাদের রাণী এখনও রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু ভারতে এসব বিলুপ্ত করে দিয়েছিল তাদের লুন্ঠনের স্বার্থে। অবশ্য এ কথাগুলো নতুন নয়। তবুও মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়া ভাল। তাই ধান বানতে একটু শিবের গীত গেয়ে নিলাম।
দুই কোরিয় নেতার গত দু’দিন আগের এই গলায় গলায় মিলে যাবার কারণ কি শুধুই তাদের নিজস্ব উপলব্দি? না-কি বিশ্ব মোড়লদের ভাড়াটে লালন-পালনের ভাড়ারে ঘাটতি পড়েছে? না-কি অন্যকিছু।
ইংরেজরাতো অনেক আগেই ঘরে উঠেছেন। মার্কিনীরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে পাততাড়ি গোটিয়ে ঘর নিয়েছেন তাও বেশ আগেই। এখন তারা যুদ্ধের একটি আবহ জিইয়ে রেখেছেন সিরিয়ায়। সারা দুনিয়ায় শান্তির বাণী পৌঁছে দেয়ার দেশ মদিনা-মক্কী আরব এখন শান্তির বাণীবাহকের তকমা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নিজের বন্ধু দেশ ইয়েমেনের সাথে যুদ্ধের অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রাচীন ব্রহ্মদেশ আধুনিক মায়ানমার হয়ে বাংলাদেশের সাথে ভবিষ্যৎ যুদ্ধের মানচিত্র ঠিক করে নিচ্ছে বলেই মনে হয়। ভারতের নয়, বাংলাদেশের উচিৎ চীনের বগলে ঢুকে পড়া, এমন প্রচার দেশ-বিদেশে আজ নতুন নয়।
কোরিয়া এক সময় জাপানের শাসনাধীন ছিল। ১৯১০ সাল থেকে কোরিয়া রাজকীয় জাপান শাসন করে আসছিল। ১৯৪৫ সালের আগষ্টে আমেরিকা জাপানের নাগাসাকি শহরে পারমানবিক বোমা ফেলার পরের দিন সোভিয়েট ইউনিয়ন জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সে যুদ্ধ ছিল রুশ-মার্কিন গোপন চুক্তির ফসল। ফলে ভূগোলের ৩৮ ডিগ্রী উত্তর বরাবর জাপানের রাজকীয় শাসন শেষ হয়ে আসে। জাপানের আত্মসমর্পনের পর রুশ-মার্কিন সামরিক শক্তি কোরিয়াকে উত্তর ও দক্ষিনে ৩৮ ডিগ্রী বরাবর সমান্তরাল রেখায় ভাগ করে নেয় যুদ্ধ জয়ে তাদের দখলীয় সত্ত্ব সূত্রে।
ফলে কোরিয়া উত্তর ও দক্ষিন এ দুই ভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। কিন্তু উভয়েই পুরো কোরিয়ার শাসক হিসেবে নিজেদের দাবী করতে থাকে। ১৯৫০ সালের ২৫জুন সেই দাবীকে যুৎসই করতে উভয় পক্ষে লড়াই শুরু হয়। এ সময় উত্তর কোরিয়া ৩৮ ডিগ্রী সমান্তরাল রেখা ডিঙ্গিয়ে দক্ষিন কোরিয়ার ভেতরে ঢুকে পড়ে। সেই অপেক্ষায়ই যেনো ছিল মার্কিনীরা। জাতিসংঘের নামে তারা কোরিয়ার দক্ষিন অংশে ঢুকে পড়ে। এই ১৯৫০ সালেরই সেপ্টেম্বরে চীনারা তাদের ইয়েলো নদী সীমান্ত রক্ষায় উত্তরের সাথে জড়িয়ে পড়ে। চীনাদের আকষ্মিক এ অভিযানে জাতিসংঘ নামের মার্কিনী শক্তি থমকে যায় এবং পিছু হটে। ১৯৫১ সাল অবদি এ অবস্থা ছিল। সেই থেকেই কোরিয়া দুই ভাগ হয়ে চলে আসছিল পশ্চিম জার্মানী ও পূর্ব জার্মানীর মত। ৩ বছর দীর্ঘ যুদ্ধের শেষে ১৯৫৩ সালে পানমুনজমের এই অসামরিক এলাকাতেই যুদ্ধ বিরতি চুক্তিতে সই করেছিল দুই কোরিয়া। ২০০৭ সালে শেষ বারের মত দু’দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা আলোচনার টেবিলে বসেছিলেন। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে কূটনৈতিক স্তরে আলাপ-আলোচনা বন্ধ হয়ে যায় কিম ক্ষমতায় আসার পর। উত্তেজনা বাড়তেই থাকে। ১৯৫৩ সালের ২৭জুলাই নতুন করে জাতিসংঘ উভয়ের মধ্যে একটি সীমান্ত নির্দেশ করে দেয়।
উনিশো তিপ্পান্নের সেই পানমুনজমের ওই অসামরিক এলাকাতেই দুই নেতা মিলিত হয়েছিলেন সেদিন। স্বাভাবিক ভাবেই এসেছে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের বিষয়টিও। সামনেই আছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কিমের বৈঠকের কথা। পরমাণু নিরস্ত্রীকরণে যে তিনি রাজি, সে কথা কিম আগেও জানিয়েছেন। এদিন আবারো সেকথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
বিস্ময়ের শেষ নেই। মাস কয়েক আগেও আমেরিকাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং উন। সেই কিম-ই এ বার প্রায় উল্টোদিকে ঘুরে আলোচনায় বসতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। খুবই গভীরে গিয়ে বুঝার বিষয় এই যে দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানের বৈঠককে স্বাগত জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অবশ্য আরো বহুদেশই স্বাগত জানিয়েছে।
এমন নজিরবিহীন ঘটনায় সারা বিশ্ববাসীই বেশ কৌতুহলী চোখে পর্যবেক্ষন করছেন। বহু মানুষের জিজ্ঞাসা, সত্যিই কি তা হলে দুই ‘শত্রু’ দেশ হাত মেলাতে যাচ্ছে? আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এ যেন এক আশ্চর্য মোড়।
লণ্ডন, শনিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০১৮ সাল