দেশের বাহিরে গিয়ে শুরুতেই যেন রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের ধাক্কা খেতে না হয়, সে জন্য বাধ্যতামূলক কর্মশালার ব্যবস্থা করেছে সরকার। যারাই কাজের জন্য দেশের বাইরে যাবেন তাদেরকে এই ট্রেনিং নিতে হবে। পুরুষ শ্রমিকদের ৩ দিনের আর মহিলাদের জন্য ৩০ দিনের। কর্মশালা শেষে শ্রমিকদের দেওয়া হয় সনদপত্র। কিন্তু মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চলছে সম্পূর্ণ এ নিয়মের উল্টো। প্রশিক্ষণ না নিয়েই এই কেন্দ্রে মিলছে সনদ। টাকার বিনিময়ে এই সনদ নিয়ে ইতিমধ্যে যারাই বিদেশে গেছে তাদের অনেককেই বিপাকে পড়তে হয়েছে। আবার কেউ কেউ চাকুরি হারিয়ে দেশেও ফিরছেন।
জানা যায়, বিদেশে গমনেচ্ছু শ্রমিকদের কাঙ্ক্ষিত দেশের ভাষা, আইনকানুন, কাজের ধরণ থেকে শুরু করে প্রাথমিক কিছু ধারণা দেওয়া হয় এই কর্মশালায়। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, অফিসের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রতিনিয়ত দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার বিনিময়ে(পুরুষ যাত্রীদের) প্রশিক্ষণ ছাড়াই এই সনদ বিক্রি হচ্ছে। রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের স্বজনরা বলেন, প্রশিক্ষণ না নেয়ায় প্রবাসে গিয়ে তাদের হয়রানির স্বীকার হতে হয়। অনেকেই আবার চাকুরি হারিয়েছেন। মহিলাদের কাছ থেকে ৩০ দিনের জন্য নেয়া হচ্ছে ১০ হাজার টাকা।
মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সিলেট বিভাগের বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা, পুরো হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলা এবং ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার কয়েকটি উপজেলার বিদেশ যাত্রীরা প্রশিক্ষণ নেন। করোনায় দীর্ঘ দিন ভিসা প্রসেস বন্ধ থাকায় সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ওয়ার্কপারমিটে লোক নেয়া হচ্ছে। প্রতিনিয়ত ওই সেন্টারে প্রশিক্ষণার্থীদের ভীড় বাড়ছে।
মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেলে কথা হয় হবিগঞ্জ জেলার সিকন্দরপুর গ্রামের মোঃ মাসুদ মিয়া’র ছেলে আব্দুল্লাহ মিয়া, বাহুবল উপজেলার পশ্চিম ভাদেশ্বর গ্রামের আনু মিয়া, উত্তর দৌলতপুর গ্রামের রুবেল মিয়া এবং চুনারুঘাটের গফুর মিয়ার ছেলে আব্দুল করিমের সাথে। তারা সবাই জনপ্রতি ২ হাজার টাকা দিয়ে প্রশিক্ষণ সনদ কিনেছেন। বিদেশ যাত্রী কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল গ্রামের সৌদিআরব প্রবাসী ইসলাম উদ্দিন বলেন, ২ হাজার টাকা দিলে পুরুষ বিদেশ যাত্রীদের প্রশিক্ষণ দিতে হয়না। ঘরে বসেই সনদ পাওয়া যায়। জুড়ী উপজেলার ময়না মিয়া, শ্রীমঙ্গলের রিয়াদ হোসেন সহ অনেকের সাথে কথা হলে তারা সবাই একই কথা বলেন।
এদিকে প্রশিক্ষণে অংশ গ্রহণকারী একাধিক প্রশিক্ষণার্থীর অভিযোগ, “২/৪জন প্রশিক্ষণ নিলেও গল্প গুজব ব্যতিত এখানে আর কিছুই শিখানো হয়নি। সবাই বসে আড্ডা দেয়। এখানে সময় পাস ছাড়া কিছুই হয়না।
ভুক্তভোগীরা জানায়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিদেশগমনেচ্ছু শ্রমিকদের তিন দিনের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করলেও অনেক ক্ষেত্রেই কর্মীকে কর্মশালায় অংশগ্রহণ না করিয়েই বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তির পর উপস্থিত দেখিয়ে টাকার বিনিময়ে সনদ দেওয়া হচ্ছে। মৌলভীবাজার টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের(টিটিসি) কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা তাদের মনোনীত দালালদের মাধ্যমে এসব সনদপত্র সংগ্রহ করে দিচ্ছে।
এদিকে মৌলভীবাজার টিটিসিকে কেন্দ্র করে একটি দালাল চক্র গড়ে উঠেছে। টিটিসির সামনের বেশ কয়েকটি দোকান সনদ বিক্রি বাণিজ্যের সাথে জড়িত। পরিচয় গোপন রেখে মা লাইব্রেরী, স্পোর্টস এন্ড কম্পিউটারে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, পুরুষের ট্রেনিংয়ের জন্য ২ হাজার এবং মহিলার ১ মাসের ট্রেনিংয়ের জন্য ১০ হাজার টাকা দিলে প্রশিক্ষণ ছাড়াই সনদ দেয়া যাবে। পরিচয় গোপন রেখে মঙ্গল ও বুধবার জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসে গেলে অনেক বিদেশ যাত্রীদের সাথে কথা হয়। এর মধ্যে দেখা যায় অনেকেই প্রশিক্ষণ না নিয়ে টাকার বিনিময়ে টিটিসি থেকে সনদ এনে ফিঙ্গার দিতে এসেছেন।
পরিচয় গোপন রেখে মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কর্মচারী মিজানের সাথে কথা হলে সে বলে, সনদ নিতে প্রশিক্ষণ নিতে হবে না। পুরুষের ৩ দিনের ট্রেনিংয়ের জন্য ২ হাজার ও মহিলাদের ১ মাসের ট্রেনিংয়ের জন্য ১০ হাজার টাকা দিলেই সনদ পাওয়া যাবে। শুধু প্রয়োজনীয় কাগজ দিয়ে সনদ নিয়ে যাবেন। একদিনও আসতে হবে না।
এভাবে প্রতিদিনই শতশত সনদ টাকার বিনিময়ে বিক্রি হচ্ছে। যার কারণে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই মহতি উদ্যোগ ভেস্তে যাচ্ছে। নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত দেশের সাধারণ মানুষ।
এবিষয়ে মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ শেখ মোহাম্মদ নাহিদ নিয়াজ বলেন, “আমি ১২ দিনের প্রশিক্ষণে মৌলভীবাজারের বাহিরে। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নয়। এ রেওয়াজ তো ১২ দিন ধরে চলছে না, কয়েক বছর ধরে চলছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাহলে আমি অবগত ছিলাম না।
|