গ্রাম আদালতের মাধ্যমে অসহায় আরব আলী তার বিশ হাজার টাকা ফিরে পেলবিশেষ বার্তাপরিবেশক।। গ্রাম আদালত বিষয়ক চাঁদপুরের ডিস্ট্রিক্ট ফ্যাসিলিটেটর নিকোলাস বিশ্বাস সম্প্রতি কচুয়া উপজেলার অন্তর্গত সাচার ইউনিয়নের গ্রাম আদালত পরিদর্শনে যান। আদালতের নথি ও রেজিস্টার পরিবীক্ষণ করে তিনি আদালতের কয়েকজন উপকারভোগীর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য গাঁয়ের দিকে যান। দুপুরের কড়া রোদে দীর্ঘ আধা-পাকা ভঙ্গুর-প্রায় রাস্তা পেরিয়ে তিনি দুই জন উপকারভোগীর সাথে তাদের বাড়িতে দেখা করেন এবং গ্রাম আদালতের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন এবং তাদের মতামত শোনেন। এদের মধ্যে একজন ছিলেন এই ইউনিয়নের অন্তর্গত বজরীখোলা গ্রামের বয়োঃবৃদ্ধ আরব আলী। এসময় আরব আলী প্রচণ্ড গরম থেকে রক্ষা পাওয়ার ইচ্ছায় তার ঘরের সামনে ডাটা ক্ষেতের পাশেই গাছের তলায় বসেছিলেন। তার সাথে গ্রাম আদালত বিষয়ে আলাপ তুলতে গেলেই আরব আলী আবেগে আপ্লূত হয়ে পড়েন। আরব আলীর বয়স বর্তমানে প্রায় ৭০। তার পরিবারে মোট তিন ছেলে ও তিন মেয়ে ছিল কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। এক সময় তার তিন ছেলেই দুরারোগ্য রোগে একে একে মারা যায়। বর্তমানে তার স্ত্রী রোগে-শোকে দীর্ঘ দিন ধরে শয্যাশায়ী। নিজেও বয়সের ভারে কোন আয়-রোজগার করতে পারেন না। অনেক কষ্টে আরব আলী তার তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এই তিন মেয়ের সাহায্য সহযোগিতা নিয়েই তিনি তার পরিবার চালান। বর্তমানে ছোট মেয়েটি তার সঙ্গে থাকে। মেয়েদের মধ্যে বড় মেয়েটি চট্রগ্রামের একটি পোষাক কারখানায় চাকরী করে। আবর আলী বলেন, গ্রাম আদালত আমার হারানো বিশ হাজার টাকা ফিরিয়ে দিয়েছে। আমাদের ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালত কার্যকর না থাকলে আমি আমার এই টাকা কিছুতেই ফিরে পেতাম না। তাকে কিছু জীজ্ঞেস করার আগেই তিনি তার কাহিনী বলতে শুরু করেন। নির্ধারিত পনেরো দিন পার হয়ে যাওয়ার পর আরব আলী প্রতিবেশী কালু মজুমদারের কাছে তার ধার দেওয়া টাকা ফেরত চায়। কিন্তু কালু মজুমদার ধারের টাকা দেই-দিচ্ছি করে টাল-বাহানা শুরু হরে। এভাবে কয়েক মাস কেটে যায়। এই টাকা উদ্ধারের জন্য এলাকায় বহুবার সালিশ-দরবার হয়েছে। প্রতিবারই কালু মজুমদার টাকা ফেরত দেওয়ার অঙ্গিকার করে এবং প্রতিবারই তা ভঙ্গ করে। কোনভাবেই আরব আলী তার টাকা ফেরত পাচ্ছে না। ক্লান্ত-শ্রান্ত এবং ভগ্ন মনোরথ হয়ে এক সময় অসহায় আরব আলী এই টাকা পাওয়ার আশা ছেড়েই দেয়। এর কিছুদিন পর একদিন বিকেলে আবর আলী পাশের বাড়িতে একটি উঠান-সভায় যোগদান করেন। তিনি বলেন, ঐ দিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির কারণে আমরা সবাই ঐ বাড়ির একটি ঘরের বারান্দায় বসি। উঠান-সভাটি পরিচালনা করছিল মিঠুন চক্রবর্তী। পরে শুনেছি সে গ্রাম আদালতে চাকরী করে। ঐ উঠান-সভায় আমি জানতে পারি যে, গ্রাম আদালতে মাত্র ১০ টাকা ও ২০ টাকা ফি দিয়ে অতি স্বল্প সময়ে সহজেই বিচার পাওয়া যায়। আমি যেন আবার আমার ঐ ধার দেওয়া টাকা ফিরে পাওয়ার আশা খুঁজে পেলাম। সভা শেষে আমি মিঠুনকে আমার ঘটনাটি খুলে বলি। মিঠুন বিস্তারিত শুনে আমাকে সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি গ্রাম আদালতে আসার পরামর্শ দেয়। এমন খবরের ফলে তিনি বিলম্ভ না করে পরের দিনই সাচার ইউনিয়নের গ্রাম আদালতে এসে আদালত সহকারী মিঠুনের সাথে দেখা করেন। আদালত সহকারীর পরামর্শ মোতাবেক মামলাটির ধরণ দেওয়ানী প্রকৃতি হওয়ায় মাত্র ২০ টাকা ফি দিয়ে তিনি তার পাওনা বিশ হাজার টাকা ফেরত চেয়ে কালু মজুমদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। গ্রাম আদালতে অভিযোগটি মামলা আকারে নথিভূক্ত হওয়ার পর ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ ওসমান গণি মোল্লা গ্রাম পুলিশ মারফত মামলার প্রতিপক্ষ কালু মজুমদারের প্রতি সমন জারি করেন। সমন পেয়ে কালু মজুমদার যথাসময়ে গ্রাম আদালতে আসেন এবং দায় স্বীকার করে উপস্থিত সবার সামনে নগদ দশ হাজার টাকা ফেরত দেন এবং বাকী দশ হাজার টাকা এক সপ্তাহ পরে দেওয়ার জন্য সময় প্রার্থনা করেন। উল্লেখ্য যে, এক সপ্তাহ পরে বাকী দশ হাজার টাকাও কালু মজুমদার আরব আলীকে ফেরত দেন। এভাবে গ্রাম আদালতের মাধ্যমে অসহায় বয়োঃবৃদ্ধ আরব আলী তার দীর্ঘ দিনের পাওনা মোট বিশ হাজার টাকা ফিরে পান।। |