মুক্তকথা প্রতিবেদন॥ ধর্ষণ! জ্ঞানেন্দ্র মোহন দাস প্রণীত সাহিত্য সংসদের বাংলা শব্দকোষে ধঁর্ষণের অর্থ বলা হয়েছে হিংসা বা ক্রোধ করা, প্রগল্ভতা, দলন, পীড়ন; পরাভব করণ, বলপূর্বক গ্রহন, বলাৎকার; ঔদ্ধত্য, অমর্ষ, অহংকার।
এই এগারোটি অর্থের মাঝে দশটিকে নিয়ে আমাদের তেমন শিড়ঃপীড়া নেই।
প্রতিদিনই আমরা কেউ না কেউ, কারো না কারো হিংসা-ক্রোধের শিকার হচ্ছি। হয়তো কেউ কেউ একটু বাক-বিতণ্ডা করছি অন্যরা নীরবে সহে যাচ্ছে। দলন-পীড়নও অহরহ আমাদের সমাজে ঘটছে। মাত্রাটা একটু বেশী হয়ে গেলে আমরা একটু গালমন্দ করি। বড়জোড় গ্রামীণ বিচার পর্যন্ত গড়ায় বিষয়গুলো।
পরাভব করণ কিংবা বলপূর্বক গ্রহন এগুলোও সচরাচরই ঘটছে। এসব ক্ষেত্রে আমরা উদ্বিঘ্ন হই, আদালতে মামলা পর্যন্ত গড়ায় বিষয়টি কিন্তু হায় হায় সব গেলো সব গেলো অমন মাত্রায় উত্তেজিত হই না।
ঔদ্ধত্য, অমর্ষ আর অহঙ্কার এ তিনটে বিশেষণও আমরা আমাদের জীবনে প্রত্যক্ষ করি হররোজ। বাক-বিতণ্ডা পর্যন্তই থেকে যায়।
শুধু একটি অর্থকে আমরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারিনা। আর সেটি হলো “বলাৎকার”!
কেনো মেনে নিতে পারিনা? তাৎক্ষনিক সহজ কোন উত্তর আমার হাতেও নেই, মনেও নেই। শুধু বুঝি, আমরা এ বিষয়টি মেনে নিতে পারি না। এর একটি স্থায়ী বিহীত আমরা গোটা দুনিয়ার মানুষই চাই। যে নমুনায় পারি এর একটি যথাবিহীত আমাদের করতেই হবে। এমন ইচ্ছা সকল মানুষের হৃদয়ের ইচ্ছা কি-না আমি জানি না। তবে ধরে নেই যে এমন ইচ্ছা সকলের হৃদয়েরই ইচ্ছা। আর তাইতো এখন দেখি বৃটেনে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু হতে যাচ্ছে যৌণশিক্ষা। এর বিরুদ্ধে অবশ্য মতও রয়েছে।
বলাৎকারকে মেনে নিতে হবে এমন কিছু বয়ান করা আমার আদৌ কোন উদ্দেশ্য নয়। তবে যে কারণে আমরা মেনে নিতে পারি না সেই কারণখানার বিষয়ে আমার খোঁজার কিছু আছে বলেই মনে করি।
রং-তামাসা নয়, খাঁটী কথা এই যে মানুষসহ প্রাণী জগতের সকল প্রাণীই আমরা স্ত্রী-পুরুষের মিলনের ফসল। সেই মিলনইতো কোন এক বিশেষ কারণে হয়ে পড়ে ধর্ষণ! দুই বিপরীতধর্মী শক্তির লড়াই ও মিলন প্রকৃতির অমোঘ বিধান বা নিয়ম বলেই শুনে আসছি অদ্যায়ূ পর্যন্ত। এ নিয়মকে হৃদয়ের গভীর থেকে মেনে নিয়ে যদি আমরা কোন পথ বের করতে পারি তা’হলেই একমাত্র এই বলপ্রয়োগ বা বলাৎকারকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবো। অন্যতায় কোন দিনও পারবো না। হয়তোবা মানুষের মনের গভীরের এমন কান্না থেকেই নারী-পুরুষে বয়োসন্ধীর সাথে সাথেই মিলিয়ে দেয়ার চিন্তার উৎপত্তি। যাকে আমরা এখন ‘বিবাহ’ বলেই যানি।
কে বা কারা, কিংবা দুনিয়ার কোথায় প্রথম এ চিন্তাটির সূচনা হয়েছিল তার চুম্বক একটি সূত্র পাওয়া যায় মহাভারতীয় ঋষিদের ইতিহাস ঘাটালে। সে খৃষ্ট জন্মের ৮শত বছর আগের কথা।গৌতম বৌদ্ধেরও আগের কথা। অর্থাৎ এখন থেকে ২হাজার ৮শত বছর আগের কাহিনী। বৃহদারোণ্যক উপনিষদ ও ছান্দৌজ্ঞ উপনিষদের কথা। এক ছিলেন ঋষি, নাম ছিল উদ্ধালক। একদা এই ঋষি উদ্ধালককে তার পুত্র শ্বেতকেতু এসে খুব উত্তেজিত হয়ে বললেন তার মা’কে একজন পুরুষ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। পিতা উদ্ধালক মুণি পুত্রের উদ্বেগ উত্তেজনা দেখে বললেন এই সাধারণ বিষয় নিয়ে তুমি এতো উত্তেজিত হয়েছো পুত্র। নারীর উপর পুরুষের অধিকার আছে। দুশ্চিন্তা করো না। পিতার উত্তরে শ্বেতকেতু মনের মাঝে খুব কষ্ট পেলেন। ঘটনাটিকে তিনি সহজভাবে নিতে পারলেন না। মায়ের এ ঘটনাটি সবসময় তাকে ভীষণ যন্ত্রণা দিত। যতই হোক নিজের জন্মদাত্রী মা’তো। সেই থেকে শ্বেতকেতু এ বিষয়টি নিয়ে ধ্যান-ভাবনা শুরু করলেন। বড় হয়ে ঋষিত্ব অর্জনের পর তিনি তার শিষ্য অনুসারীদের একদিন ডেকে এনে বললেন, আজ থেকে একজন নারীর উপর একজন পুরুষেরই অধিকার থাকবে। মা-বাবার সামনে অগ্নিকে সাক্ষী রেখে নারী ওই একজন পুরুষের প্রতি সারাজীবন তার আনুগত্য স্বীকার করে যাবেন। আর পুরুষও তার সবকিছু দেখভাল করবেন। আর সেই থেকেই বিবাহের সূচনা। অন্ততঃ আমাদের উপমহাদেশের ইতিহাস তাই লিখে। পরবর্তী জীবনে শ্বেতকেতুও মহাঋষিত্ব অর্জন করেছিলেন।
সুপ্রাচীন অতীতের সেই দিন থেকে শুরু করে গোটা উপমহাদেশে আজ অবদি বিবাহ প্রথা চলে আসছে। একই নমুনার এই বিবাহ প্রথা এখন বিশ্বের সকল মানব সমাজেই চালু আছে বলে আমি মনে করি। কিন্তু এতোকিছুর পরও বলাৎকার বা ধর্ষণকে থামানো যাচ্ছে না। শুধু যে বাংলাদেশে ধর্ষণ ঘটছে তা-তো নয়। বিশ্বব্যাপী এখন সকল মানুষের বড় দুশ্চিন্তার বিষয় এই বলাৎকার বা ধর্ষণ। ধর্মবাদী কেউ কেউ বলেন মেয়েদের কাপড় পরিধানের নমুনাই ধর্ষণের উস্কানী দেয়। তারা বুঝাতে চান যে মেয়েদের গোটা শরীর ঢেকে রাখলে বিশেষ করে মুখ ঢেকে রাখলে ধর্ষণ নিঃশ্বেস না হলেও বহুল হারে কমে আসবে। কিন্তু পোষাক পড়ার ধরনই যদি ধর্ষনের মূল কারণ হয়ে থাকে তা’হলে মাদ্রাসার বোরখা পড়া মেয়েকে মৌলানা কি করে ধর্ষণ করে? পোষাককে দায়ী করে তারাই যারা এসব বিষয়কে আন্তরিক গুরুত্ব না দিয়ে দায়সারাভাবে দেখে। আমরা জানি পাশ্চাত্যের দেশে নারীদের পোষাক আমাদের মৌল ধারণায় উলঙ্গপনার সামিল। কিন্তু আনুপাতিক হারে এসব দেশে ধর্ষণ একেবারে নেই তেমন নয় কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান এসব দেশের তুলনায় একেবারেই অনুল্লেখযোগ্য। অতএব পোষাকের বিষয়টি একেবারেই আমলে নেয়ার বিষয় নয়।
তা’হলে স্বভাবতঃই প্রশ্ন আসে কেনো এমন মাত্রায় ধর্ষণ? ছোট্ট উত্তর, খুঁজতে হবে এবং খুঁজতে হবে। এই খুঁজে দেখা ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই ধর্ষণের কারণ জানার। প্রয়োজনে সরকারকে সমঝে নিয়ে কোন বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়ীত্ব দিতে হবে খুঁজে বের করার। এটি একটি গবেষণার বিষয় বৈকি! চটজলদি হাতের চুটকি দিয়ে কারণ বলে দিতে পারবেন এমন কোন বৈজ্ঞানিক, ডক্টর, শিক্ষকসহ কোন বিদ্যান নেই। দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়কে অর্থসহ দায়ীত্ব গবেষণার দায়ীত্ব দেয়া হোক। তারা দায়ীত্ব নিলে এক বছরে না হোক ৩বছরে একটি সুন্দর কাজে লাগার মতো সমাধান বের হয়ে আসতে বাধ্য।
বিগত দুমাসে ধর্ষণের অতি সামান্য কিছু খবর যা, কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
ছাত্রকে যৌন নিপীড়নের দায়ে মাদ্রাসা শিক্ষককে পুলিশ ধরেছে।
বিশ্বনাথে ভাতিজিকে ধর্ষণের অভিযোগে চাচাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এই নভেম্বরেই পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলার পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নে ১৩ বছরের এক প্রতিবন্ধী শিশুকে ধর্ষণ করেছে ৫৫ বছর বয়সী কাঠমিস্ত্রি প্রতিবেশী সুভাষ দেবনাথ। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে।
এর আগে বিগত ৯ অক্টোবর ২০২০ বড়লেখার আতুয়ায় ধর্ষিতা হয় ১৮ বছরের এক কন্যা। পরিচিত বেবী টেক্সীর ড্রাইভার ও এক চৌকিদার মিলে তাকে ধর্ষণ করে। ধর্ষকদের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
মৌলভীবাজার জেলা সদরে ৬নং একাটুনা ইউনিয়নের খোঁজারগাঁও গ্রামের আব্দুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে ধর্ষণ করে আসছেন তার বাড়ীর কাজের মেয়েকে। তার এ কাজের সহযোগী মেয়ের মা, খালা ও নানী। গত ১০ নভেম্বর মেয়ের কান্দনে জানাজানি হয়ে যায়। অবশ্য আব্দুর রহমান বলেছেন তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ।
১২ বছরের মেয়েকে ধর্ষণ করেছে মাওলানা রিয়াজ উদ্দিন নামের এক মসজিদ ইমাম। ঘটনাটি কানাইঘাটের বাউরভাগ প্রথমখণ্ড গ্রামের। ঘটেছে বিগত ৮অক্টোবর ২০২০। ধর্ষক রিয়াজের বয়স ৩০ বছর। পুলিশ রিয়াজকে গ্রেপ্তার করেছে। অবশ্য ঘটনাটি সাজানো বলেও জানা গেছে।
এমন কথা কেউ কি বিশ্বাস করবেন যে ৫৫ বছর বয়সের এক ধর্ষক ৪বছরের বাচ্চা মেয়ের যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কাঠার চেষ্টা করে একটু বড় করে নেয়ার জন্য। শিশুকন্যার আর্ত চিৎকারে লোকজন জড়ো হয়ে এ বিষয়টি দেখতে পান। শিশুকন্যাকে ডাক্তারে পাঠানো হয় এবং ধর্ষককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনা ঢাকার খিলগাঁও এর।
একজন মাহমুদ’এর ছবি ও উদৃতি দিয়ে “ধর্ষকের মুখ” ফেইচবুক লিখেছে- মাহমুদ মনে করেন নারীর পোশাক নাকি যৌন সুড়সুড়ি জাগায়। ওই ফেইচবুক খানাই মন্তব্য করেছে যে ভবিষ্যতে মাহমুদ পোশাকের ওজুহাতে ধর্ষণে শরীক হতে পারে।
পোষাকই যদি ধর্ষণের কারণ হয়ে থাকে তা’হলে মাদ্রাসায় বোরখা পড়া ছাত্রী ধর্ষণ হয় কিকরে?
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্যমতে, ধর্ষণের পর ৯০ শতাংশ আসামি চূড়ান্ত বিচারের আগেই খালাস পেয়ে যায়। আইনে ধর্ষণ মামলার তদন্ত ৯০ কার্যদিবস ও বিচার ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে হওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মামলার তদন্তের চার্জশিট সঠিক সময়ে দেওয়া হয় না, মেডিকেল রিপোর্টে গরমিলসহ বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে তা বছরের পর বছর বাড়ানো হয়।
অনেকে মনে করেন, ধর্ষকদের আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না বলেই ধর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে।