-আবু মাহমুদ
নামাজে দাড়িয়ে নিয়ত পড়তে হবে না। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের বেশ কিছু ইসলাম ধর্মীয়গুরু অন্যকথায় মোল্লা-মৌলভীগন এরূপ মত ব্যক্ত করেছেন। ইউটিউবে এ বক্তব্যের প্রচুর ভিডিও আপলোড করা হয়েছে। যারা এসব বলছেন তারা যে নেহায়েৎ মামুলী কতিপয় কটমৌলভী তা নয়। এদের অনেকেই বেশ দু’কলম লেখা-পড়া করেছেন বলে শুনেছি। কমচে কম আরবী ভাষা ও ইসলামী চিন্তার স্কুল বা কলেজে গিয়েছেন। এদের মাঝে বাঙ্গালী দু’একজনকে আমি চিনি, মাঝে-মধ্যে বিলেতের দু’একটি বাংলা ‘চ্যানেলে’ বিজ্ঞাপন ব্যবসার আনুকূল্যে এদের, মানব সেবার নামে মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে ব্যস্ত সময় কাটাতে দেখি।
তাদের বক্তব্য, নিয়ত হলো মনের ইচ্ছা। মনের ইচ্ছা নিয়ে দাড়ালেইতো ‘নিয়ত’ হয়েগেলো। পড়ার প্রয়োজনটা কোথায়! এ কথায় তাদের চিন্তা-চেতনার দৌড় বুঝতে বেগ পেতে হয় না। বিশ্বে গড়ে উঠা প্রায় দশ সহস্রাব্দের মানব সভ্যতায় এমন বহু নিয়ম ও প্রথা রয়েছে যা শত শত বছরের অনুশীলনের মধ্যদিয়ে গড়ে উঠেছে এবং তা মানবসমাজে কালোত্তীর্ণভাবে গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছে। বিভিন্ন মত ও পথের ধর্ম নিয়ে বিতর্ক সবসময়ই আছে। মাঝে মধ্যে এসব বিতর্ক খুনোখুনী থেকে যুদ্ধে রূপ নিয়েছে এও যেমন সত্য আবার এসব মতের নিঃসংকোচ অনুশীলনও চলে আসছে এও সত্য। গভীর মনোনিবেশ করলে দেখা যায় বিশ্বমানবসভ্যতা এভাবেই গড়ে উঠেছে। এভাবেই বিস্তৃত হয়েছে। মানব সভ্যতার দশসহস্রাধিক বছরের সত্যনিষ্ঠ বিভিন্ন মত ও পথের নিরবিচ্ছিন্ন অনুশীলন মতকে আদর্শ তত্ত্বে রূপান্তরীত করেছে। বহু কিছুকে সর্বজনগ্রাহ্য নিয়ম ও প্রথায় গড়ে তুলেছে।
অনেক কাল আগের কথা। তখন আমি সবেমাত্র উকালতি ব্যবসায় পা দিয়েছি। আমার কলেজ জমানার এক সাথী, পরবর্তীতে মৌলানা হয়ে এক মাদ্রাসায় অধ্যক্ষের দায়ীত্বে ছিলেন, তারই আত্মীয় অপর এক অধ্যক্ষ মৌলভীর বিরুদ্ধে আদালতে সম্পদ ও অর্থ তসরুপের মামলা দায়ের করেন। তার উকীল হয়ে আমি এ মামলা দায়ের করি। ওই সময়ই বন্ধু মৌলানার সাথে আলাপ করতে গিয়ে জানতে চেয়েছিলাম ‘সময়’ বলতে আমরা কি বুঝি? ১(এক) বলতে আমরা কি বুঝি? উত্তরে তিনি বলেছিলেন মানুষের ভাব ও আবেগ মানুষকে প্রার্থনা শিখিয়েছে। প্রার্থনার মধ্যদিয়ে মানুষ বিনোদিত হয়। মানুষের ব্যাকুল মনের হাজার হাজার বছরের প্রার্থনার নিখাদ অনুশীলন মানুষকে জ্ঞানদান করেছে, মানুষের জ্ঞানের বিকাশ ঘটিয়েছে। বিকশিত সে জ্ঞান দিয়ে মানুষ জীবনকে নিয়ে জীবনের চর্চ্চা করে। আর এই চর্চ্চার পথেই হয় মানুষের নব নব আবিষ্কার, মনের মুক্তি। ঘনিষ্ট বন্ধু না হলেও আমি তার কথায় সবসময়ই গুরুত্ব দিতাম। কারণ আমার ওই সহপাঠী ছিলেন একজন খাঁটী মৌলানার একমাত্র সন্তান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি লন্ডন সফরে এসে ফিরে গিয়েছিলেন এজন্যেই যে এখানে ইসলামী জীবনধারণ সম্ভব ছিলনা। আর তখন সত্যই বিলেতের জীবনমান এমনই ছিল।
কথা প্রসঙ্গে আমার সুহৃদ সেই মৌলানাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দিনের নাম-মাসের নাম এসব বদলে দিয়ে আরবীয় সংস্কৃতির দিনের নাম ও মাসের নাম চালু করতে পারলেতো ইসলামের প্রতিষ্ঠা আরো ত্বরান্বিত হতো। তিনি হেসে দিয়ে বলেছিলেন এগুলো কালোত্তীর্ণ নাম ও ব্যবস্থা। বললেই এগুলো বদলানো যাবে না। আর ইসলাম ধর্মও কারো সংস্কৃতিকে বদলে দেয়ার কোনরূপ পথ দেখায়নি। আর- শনি, রবি, সোম কিংবা বোশেখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় এগুলো মানব সভ্যতার শত শত, হাজার হাজার বছরের অনুশীলনের ফসল। হাজার হাজার বছরের জীবন চর্চ্চায় এগুলো মানব জীবনের সাথে একীভূত হয়ে গেছে। এগুলোর কোন আধুনিক ব্যাখ্যা পাওয়া না গেলেও মানুষের জীবন চর্চ্চায় এসব উপাত্ত হয়ে এমনভাবে মিশে গেছে যে এগুলো বাদ দেয়াতো দূরে থাক পরিবর্তনের চিন্তা একমাত্র আহাম্মক ছাড়া কেউ ভাবতে পারে না।
শনিবার বা রোববার, সোমবার বা মঙ্গলবার এগুলো দিনের নাম। কেউ যদি বলে দিন আবার কি? সময়ই বা কি? এক ঘন্টা কি? কতটুকু জায়গা নিয়ে ১ঘন্টা! আর এসব দিয়ে কি হবে। যদিও এ প্রশ্নের কোন উত্তর নেই তবুও প্রশ্নটি উদ্ভট নয়কি?
এসবের কোন প্রয়োজন নেই! শনি থেকে শুক্র এ ৭টি দিনের নাম যদি মানতে না-ও পারেন তবে পড়তেই হবে। অর্থাৎ জীবনাচরণ থেকে এদের চাইলেই বাদ দিতে পারবেন না। যে কেউ এমন চেষ্টা করে দেখতে পারেন! ভাবতে পারেন, আপনি দিন মানেন না, মাস মানেন না, সময় জানতে চান না। এসবের কোন প্রয়োজন নেই নিজের জীবনে। এভাবে কি জীবন চালাতে পারবেন? সহজ সরল উত্তর পারবেন না। এ অবস্থায় যদি কেউ বলে, মনের ইচ্ছায় এগুলো গেঁথে রেখে দিলেই হবে। লিখতে পড়তে হবে না। তা’হলে কেমন হবে? তাকে হাসি-তামাশার উপযুক্ত পাগল বলে কি উপহাস করা হবে না!
আমার ক্ষুদ্র ধারনায় নামাজের নিয়ত পড়তে হবে না তেমনি এক পাগলের প্রলাপ! এসব বিতর্ক দিয়ে ফ্যাসাদ প্যাঁচানো যাবে, কোন ধরণের গোপন উদ্দেশ্য হাসিল করা যাবে, বিশ্ব জীবজগতের ভাল কিছু করা যাবে না কোন উপায়েই।