দিপু কোরেশী
প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে বাস্তবতার সাথে যথাসম্ভব সামঞ্জস্য রেখে বস্তু প্রিয় তবে বস্তুবাদী হতে নারাজ। আধুনিক তবে আমদানিকৃত বিজাতীয় দিবসে দিবসবাদী হতে চাই না। যথারীতি এখনো আপনজনের জন্মদিন সহ বিশেষ দিন ভুলে যাওয়া এমন মানুষের পক্ষে এরকম হওয়াটা সম্ভবও নয়। তাছাড়া একই ঘরের একই ছাদের নিচে বাস করে আপনজনকে বিশেষ দিনের শুভেচ্ছা সহ একসাথে পথ চলার সুখ-দুঃখের হালকা গল্প সোশ্যাল মিডিয়াতে এসে জানান দেয়া দেখলে যেখানে হাস্যকর, অযৌক্তিক লাগে সেখানে তো কিছুটা ব্যাকডেটেড বলাও যায়। অনেক আগে একবার ব্যাংকে টাকা উঠাতে গেলে ব্যাংক কর্মকর্তা উইথড্র এমাউন্ট বেশি হবার কারণে আমাকে প্রশ্ন করেন, আমার বয়স কতো? কনফিউজড্ আমি তখন উত্তর দেই, বয়স সম্ভবত ২৭ বা ২৮ বছর হবে! পরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আঙুলেই বয়স হিসেব করা শুরু করি! এমন কান্ড দেখে অবাক হয়ে ঐ কর্মকর্তা সহ উনার কলিগ তাকিয়ে দেখছিলেন। বয়স গোনা দেখে তাঁদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এতে তাঁদের সন্দেহ বেড়ে যায়। সবাই মিলে আমাকে প্রশ্ন করে, বয়স জানি না কেন? এটা-সেটা ইত্যাদি। আমি বললাম, তোমাদের মতো বয়স নিয়ে ভাবার আর বার্থডে পালন করার এতো সময় আমাদের নাই। কিছুটা বিব্রত হয়ে ঘামতে শুরু করি। পরে ঘর থেকে পাসপোর্ট, চেকবুক আনার পর সমস্যার সমাধান হয়।
পশ্চিমা ভোগবাদের পৈশাচিক চেহারা। ছবি: অন্তর্জাল
যান্ত্রিক জীবনে মানুষ এখন আনন্দের উৎস খুঁজেন। আনন্দ এখন উপলব্ধি আর উপভোগের চেয়ে আনুষ্ঠানিক বেশি। আগে ঘরের কোণে সুখ থাকলেও এখন সুখ খুঁজতে হাজার মাইল দূরে যেতে হয়, তবুও সুখ মিলে না। ভালোবাসা এখন সংক্ষিপ্ত। ভোগটাই আসল। বস্তু, ভোগ আর দিবস নির্ভর পাশ্চাত্য সংস্কৃতির পিছনে আমরাও অহর্নিশ ছুটে চলছি পাগলের মতো। আর ট্যাকনোলজি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এই ছুটে চলাকেও আরো সহজ করে দিয়েছে।
নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিক থেকে ভিনদেশি সংস্কৃতির কোন বিশেষ দিবস আমাদের দেশে প্রথম ঢুকতে থাকে। বুঝে বা না বুঝে আধুনিকতার মন্ত্রে মুগ্ধ হয়ে ধীরে ধীরে আমরা আকৃষ্ট হতে থাকি ঐসব দিবসে। এখন বিজাতীয় বিভিন্ন দিবসের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির উপর দখলদারিত্ব করছে আমাদের উদাসীনতার কারণে।
কয়েকযুগ ধরে বিদেশী টিভি চ্যানেলগুলোর অবাধ রাজত্বে বাঙালি ঐতিহ্য ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, জারিসারি, বাউল, মুশির্দী হারিয়ে যাবার পথে। এমনকি মাত্রাতিরিক্ত ভিনেদশি সংস্কৃতিমুখী হওয়াতে নতুন প্রজন্মের কাছে ভিনদেশি পোশাক, খাবারের প্রবণতা খেয়াল করা যায়। অপসংস্কৃতি অথবা ভিনদেশি কুসংস্কৃতির কুপ্রভাবে কথায় ও আচরণেও বর্তমান প্রজন্ম আমদানি করা নতুন এক বাঙলিশ সংস্কৃতিতেই যেন বেহুদা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আর্থিক সামর্থ্য না থাকলেও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সাথে তাল মিলিয়ে চলছে অনেকেই।
আপনজনকে ভালোবাসা জানাতে বিশেষ দিন নির্ধারণ করে আমরা আমাদের পবিত্র, খাঁটি আবেগ-অনুভূতির বিশালতাকে কৃত্রিম পন্থার জন্ম দিয়ে সংকুচিত করছি। কমার্শিয়াল সংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে উপহার দিচ্ছি দামি জিনিস। ভালোবাসা আর অনুভূতির গভীরতা নির্ণয় করছি পণ্যে। টাকায় কি সম্পর্ক পরিমাপ করা সম্ভব!
কাক হয়ে ময়ূরের নৃত্য অনুসরণ করতে গিয়ে ধর্মীয় মূল্যবোধ, নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য থেকে আমরা এখন অনেকটা দূরে। পারিবারিক ও সামাজিক চিরচেনা মহিমা, ভাবগাম্ভীর্যতা আগের মতো নেই। ধ্যান-ধারণায় আধুনিকতাকে সভ্যতা মনে করে অশ্লীলতাই এখন জীবনের স্বাভাবিক রীতি হতে চলেছে।
তখনকার দিনে মানুষ যখন তথাকথিত আধুনিক ছিলেন না তখন মা-বাবা কোন সন্তানের কাছে থাকবেন সেটা নিয়ে সন্তানদের মধ্যে মমতা ঘেরা মধুর কাড়াকাড়ি শুরু হতো। আর এখন বিত্তশালী শিক্ষিত সন্তানদের নিজেদের মধ্যে প্রয়োজনে সালিশ মিটিং হয় মা-বাবাকে কোন বৃদ্ধাশ্রমে রাখা যায়! আগে সন্তান ছিল মা-বাবার শেষ বয়সে নিরাপদ আশ্রয়ের জায়গা। এখন বিশেষ বিশেষ দিবস আর আধুনিকতার যাতাকলে মূল্যবোধ ও মানবতাকে গলা টিপে হত্যা করে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির নিষ্ঠুর উপহার স্বরূপ সরকারি/বেসরকারি বৃদ্বাশ্রমের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
যুগের সাথে আধুনিক হওয়াটাই জীবনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সুস্থ ধারার আধুনিক হওয়াটা দোষের কিছু নয়। তবে কর্জ করা সংস্কৃতি মারফত হাই-স্ট্যান্ডার্ডের আধুনিক হয়ে নিজের পরিচয়, অস্তিত্ব ভুলে যাওয়াটা দোষের। আধুনিকতার সাথে পরিচিত হয়েই আমাদেরকে টিকে থাকতে হয়। তবে তথাকথিত আধুনিকতার নামে বিবেক ও রুচিবোধ বিসর্জন দিয়ে পঁচে গিয়ে টিকে থাকাটা আত্মঘাতী।
আমরা আধুনিক হই; তবে ভোগবাদ, বস্তুবাদ, দিবসবাদে বিশ্বাসীদের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যবসার বিশ্ব কমার্শিয়াল সংস্কৃতিতে মগ্ন হয়ে নিজ সত্তাকে, নিজস্বতাকে কবর দিয়ে তথাকথিত আধুনিক যেন না হই।
|