এবার উত্তরাধিকার সূত্রে নৌকার মাঝি হয়েছেন অনেকেই। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের পরম্পরা নতুন নয়। বিভিন্ন সময় বাবার আসনে সন্তানেরা দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। কোনো কোনো এলাকায় তৃতীয় প্রজন্মের হাতেও এসেছে নৌকা প্রতীক। বাবার সূত্রে পাওয়া দলীয় প্রতীক নিয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম নির্বাচন করে যাচ্ছেন অনেকেই।
আওয়ামী লীগের অনেক নেতা নৌকা প্রতীক নিয়ে বারবার সংসদ সদস্য হয়েছেন। সময়ের চক্রে তাদের কেউ কেউ মারা গেছেন। কারও অনেক বয়স হয়ে গেছে। এবার এমন বেশ কয়েকজন নেতার সন্তানদের হাতে নৌকা প্রতীক তুলে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। নতুন করে এমন ১১ জন নৌকায় উঠেছেন। বাবার রেখে যাওয়া স্মৃতির পথ ধরে হাঁটছেন সন্তানেরা।
আওয়ামী লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বর্তমান সংসদে চট্টগ্রাম-১ আসনের সংসদ সদস্য। তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য গঠিত দলীয় মনোনয়ন বোর্ডেও আছেন তিনি। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভায়ও ছিলেন। ৮০ বছর বয়সী এই নেতা এবার বয়সের কারণে সরাসরি ভোটে অংশ নিচ্ছেন না। তারই আসনে ছেলে মাহাবুব উর রহমান পেয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন।
আওয়ামী লীগের আরেক প্রবীণ নেতা এইচএন আশিকুর রহমান ১৯৮৬ সাল থেকে রংপুর-৫ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচন করছেন। এর মধ্যে ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের কাছে হারলেও উপনির্বাচনে জয়ী হন। ২০০১ সালেও হেরে যান তিনি। গত তিনটি নির্বাচনে টানা জয় নিয়ে সংসদে আছেন এই নেতা। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ পদ সামলাচ্ছেন। বয়সের কারণে এবার ভোটে নামেননি। তার ছেলে রাশেক রহমান রংপুর-৫ আসনে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। রাশেক রহমান আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির সদস্য। রংপুর জেলা আওয়ামী লীগেরও সদস্য। তথ্যপ্রযুক্তি ও পুঁজিবাজার খাতে তার ব্যবসা আছে। মেঘনা ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক তিনি।
ঠাকুরগাঁও-২ আসনে টানা সাতবারের সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলাম আগে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) করতেন। ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে সিপিবি থেকেই নির্বাচিত হন। এরপর টানা পাঁচবার নৌকা নিয়েই সংসদে এসেছেন। ৭৫ বছর বয়সী এই নেতা এবারও নৌকার মনোনয়ন চেয়েছিলেন। বয়সের বিবেচনায় তার ছেলে মো. মাজহারল ইসলামের হাতে নৌকা তুলে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। পেশায় শিক্ষক মাজহারুল বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।
ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজি মোহাম্মদ সেলিম একসময় বিএনপি করতেন। ১৯৯৬ সালে বিএনপি থেকে দলীয় মনোনয়নও চেয়েছিলেন, পাননি। এরপর তিনি যোগ দেন আওয়ামী লীগে, ওই নির্বাচনেই নৌকা নিয়ে প্রথম সংসদ সদস্য হন। ২০১৮ সালে আবার ফিরে পান নৌকা প্রতীক। দুর্নীতির মামলায় তার সাজা হওয়ায় সংসদ সদস্য পদ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এবার তাই নিজের ছেলেকে ছেড়ে দিয়েছেন তার নির্বাচনী এলাকা। হাজি সেলিমের বড় ছেলে সুলাইমান সেলিম এবার পুরান ঢাকার আসনটিতে নৌকার প্রার্থী। পারিবারিক ব্যবসার পাশাপাশি বাবার রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও যুক্ত ছিলেন তিনি।
ওপরে বাঁ থেকে সুলাইমান সেলিম, রুমানা আলী, গালিবুর রহমান শরীফ, ময়েজ উদ্দিন শরীফ ও এস এম আল মামুন, নিচে বাঁ থেকে শাম্মী আহমেদ, মাহাবুব উর রহমান, রাশেক রহমান, মাজহারুল ইসলাম ও মোহিত উর রহমান। ছবি: সংগৃহীত |
আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা রহমত আলীর মেয়ে রুমানা আলী রাজনীতিতে এসেছেন। তিনি এবার তার বাবার আসন গাজীপুর-৩ থেকে দলের মনোনয়ন নিয়ে ভোট করছেন। ১৯৯১ থেকে শুরু করে টানা আটবারের সংসদ সদস্য ছিলেন রহমত আলী। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। কৃষক লীগের সভাপতি রহমত আলী শেষের দিকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ছিলেন। ৭৫ বছর বয়সে ২০২০ সালে তিনি মারা যান। এরপর উপনির্বাচনে সেখানে মনোনয়ন পান গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন। অবশ্য এবার নৌকা পাওয়া রুমানা আলীর বিপক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন ইকবাল হোসেন।
পাবনা-৪ আসনে ১৯৯৬ সাল থেকে টানা পাঁচ নির্বাচনে নৌকা নিয়ে জয়ী হয়েছেন শামসুর রহমান শরীফ। তিনি পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ২০১৪ সালে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ৮০ বছর বয়সে ২০২০ সালে মারা যান। এরপর উপনির্বাচনে তার পরিবারের একাধিক সদস্য মনোনয়ন চাইলেও কেউ পাননি। এবার তার ছেলে গালিবুর রহমান শরীফ পেয়েছেন নৌকা প্রতীক। উপজেলা থেকে রাজনীতি শুরু করলেও তিনি বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।
১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হন বরিশালের নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ। এরপর ১৯৭৩ ও ১৯৯১ সালের ভোটে সংসদ সদস্য হন তিনি। বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন এই নেতা। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে নৌকা নিয়ে হেরে যান তিনি। ২০০২ সালে মারা যান তিনি। তার মেয়ে শাম্মী আহমেদ আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক। প্রথমবারের মতো তার হাতে উঠল নৌকা প্রতীক। বরিশাল-৪ আসনে এবার প্রার্থী হয়েছেন তিনি।
হবিগঞ্জ-২ আসনে নতুন মুখ ময়েজ উদ্দিন শরীফ। তার বাবা প্রয়াত মো. শরিফ উদ্দিন ছিলেন এখানকার সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হন শরিফ উদ্দিন। ’৯৬ সালের জুনে সংসদ সদস্য হওয়ার মাত্র দুই মাস পর আগস্টে তিনি মারা যান ৫৬ বছর বয়সে। বয়সে ছোট থাকায় ওই সময় সন্তানদের মনোনয়নের বিষয়টি সামনে আসেনি। এবার তার ছেলে ময়েজ উদ্দিন পেয়েছেন নৌকা প্রতীক। ছাত্রলীগের রাজনীতি দিয়ে হাতেখড়ি ময়েজ উদ্দিনের। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের আইন সম্পাদক ছিলেন। এরপর আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক উপকমিটির সদস্য হন। এখন তিনি জেলা আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক। পেশায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।
ময়মনসিংহ সদর আসনে এবার প্রথমবারের মতো নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন মোহিত উর রহমান (শান্ত)। মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহিতের বাবা অধ্যক্ষ মতিউর রহমান দীর্ঘ দিন ধরে ময়মনসিংহ জেলার সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ছিলেন। ১৯৮৬ ও ২০০৮ সালে তিনি ময়মনসিংহ-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য হন। জোটের সমীকরণে এরপর তিনি আর নির্বাচন করতে পারেননি। তবে ২০১৪ সালে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারে টেকনোক্র্যাট হিসেবে ধর্মমন্ত্রী হন তিনি। ৮১ বছর বয়সে গত আগস্টে মারা যান তিনি। এবার মনোনয়ন পেলেন তার ছেলে মোহিত।
১৯৭৫ থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সীতাকুণ্ড উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন আবুল কাশেম। এর মধ্যে ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড-নগরের একাংশ) সংসদ সদস্য হন তিনি। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে এখান থেকে নৌকা নিয়ে দিদারুল আলম দুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর মধ্যে ২০১৫ সালে মারা যান আবুল কাশেম। এবার ওই আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন আবুল কাশেমের ছেলে এসএম আল মামুন। সীতাকুণ্ড উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে পদত্যাগ করে নৌকা চেয়েছিলেন মামুন। তিনি চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবলীগের সভাপতি।
জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান বাদ পড়েছেন এবার। অডিও ফাঁসসহ নানা বিতর্কিত মন্তব্য করে সারা দেশে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছিলেন মুরাদ হাসান। এবার তার বদলে ওই আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় মৎস্য ও প্রাণিবিষয়ক সম্পাদক প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান। এবারই প্রথম তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছেন। তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেক দুবার এ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে নৌকা নিয়ে জয়ী হন তিনি। ৮৫ বছর বয়সে ২০১৬ সালে মারা যান এই নেতা। ৪০ বছর সরিষাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন তিনি।