হারুনূর রশীদ।।
মিশরের নবাবিষ্কৃত মন্দিরের দেয়ালে বেবুনের মূর্তি আঁকা। কিন্তু কেন? অধুনা এক গবেষণা চালিয়ে তারই খোঁজ দিয়েছেন জাপান ও মিশরের প্রত্নতত্ত্ববিদগন। এসকল প্রত্নতত্ত্ববিদগন মিশরের থিবস এলাকায় ৩ হাজার বছরের পুরনো রাজ সমাধি খোঁজে বের করেছেন। সমাধিটি ‘খনশু’ নামে এক ব্যক্তির। সমাধির দেয়ালে লিখা আছে ‘খনশু’ একজন সত্যিকারের বিখ্যাত লেখক; আরো আঁকা আছে সূর্য্য ভগবান ‘রা’ এর পুঁজারত বেবুন পশুর ছবি। সমাধিটি বহু প্রাচীণ সেই রামেসাইড বাদশাহদের আমলের। জাপানের ওয়াছেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ ‘জিরো কন্দও’-এর নেতৃত্বাধীন একটি প্রত্নতাত্ত্বিক দল ৩ হাজার বছরের পুরনো এই সমাধিটি জনসমক্ষে নিয়ে এসেছেন এবং তারা মনে করছেন এগুলো প্রাচীন মিশরের থিবস নগরীর বিশাল গুরুস্থানের দেয়ালে বাদশাহী আমলেরই লেখা। রামেসাইড রাজাদের ১৯ ও ২০তম গুষ্ঠীর (খৃষ্ট জন্মের আগের ১২৯২ থেকে ১০৬৯ সাল) আমলের এই সমাধি মন্দির সত্যিই অবাক করার মত।
রামেসাইড আমল, প্রাচীন মিশরের খৃষ্ট পূর্ব আমল ১৬শ থেকে ১১শতাব্দি কাল ব্যাপী ছিল। এ সময় মিশরীয় বাদশাহদের ১৮তম, ১৯তম ও ২০তম বংশগোষ্ঠীর শাসনকাল বলে গবেষক প্রত্নতত্ত্বদিবদের ধারণা। এ সময় ছিল প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে সমৃদ্ধ সময়, মিশরসহ আশ-পাশের বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছিল ফারাহ’দের সাম্রাজ্য। ওয়াছেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে যে প্রত্নতত্ত্ববিদদের একটি দল এখনও বিশাল সেই গুরুস্থানের এল খোখা এলাকায় অবস্থিত “উসারহাট” সৌধের এক প্রান্ত থেকে হাজার হাজার বছরের আবর্জনা পরিস্কার করা হচ্ছে। এই “উসারহাট” হলেন রাজা ‘তুত’ এর দাদা এবং তিনি সম্রাট “তৃতীয় আমেনহোতেপ” (Amenhotep III)এর রাজকর্মচারী ছিলেন। প্রত্নতত্ত্ববিদদের গবেষণায় পাওয়া গেছে যে “উসারহাট”, সম্রাটের ব্যক্তিগত বসতঘরের রক্ষণাবেক্ষনকারী ছিলেন। (Userhat was an Egyptian official who served Amenhotep III, King Tut’s grandfather, with the title of “overseer of the king’s private apartment.”)। রাজ অভারশিয়ার এই উসারহাটের সৌধের এ পর্যন্ত পরিস্কার করা এলাকার দেয়াল, ভগবান রা এর মূর্তিসহ অসংখ্য মানুষ ও বেবুনের মুর্তিতে ভরা। কাছেই টি আকারের অপর সৌধটিই হলো লেখক ‘খনশু’র। গবেষকদল বলেন যে এই সৌধের প্রবেশ পথের উত্তরের দেয়ালে খোদাইকরা উপসনারত ৪ বেবুনের মুর্তি। বেবুন ৪টি গভীর ভালবাসার আদলে শ্রষ্টা ‘রা আতুম’এর উপাসনায় রত।
বেবুনকে আজকের দিনে আমরা দেখি, অনেকটা হিংস্র প্রকৃতির দূর্গন্ধযুক্ত কেচ কেচ স্বরের একটি পশু। কিন্তু খৃষ্টপূর্ব ১২শ শতাব্দির দিকে প্রাচীণ মিশরীয় সমাজে বেবুনের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। হাজার হাজার বছর আগের সেই মিশরীয়রা বেবুনকে ভালবাসার প্রতীকী পশু হিসেবে আদর করে ডাকতো ‘বাবি’ বা ‘বাবা’ বলে। শুধু তাই নয় তারা ভক্তিভরে বেবুনের কাছে ভালবাসার প্রতীকী প্রর্থনা করতো।
সৌধের এতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বেবুনের খোদাই করা মূর্তি থেকে এটাই অনুমান করা হয় যে বেবুন ওই সময় খুবই উচ্চ রাজমর্যাদায় রক্ষিত হতো। বেবুন খুব উগ্রমেজাজি প্রাণী, সে হিসেবে ‘বাবি’কে প্রাচীণ মিশরীয়রা দেখতো অপরাধকারীর ঘাড়ভেঙ্গে রক্তচোষা শাস্তিপ্রদানকারী স্রস্টার প্রতিভু হিসেবে। বেবুনের রয়েছে উচ্চ ক্ষমতার সঙ্গম শক্তি। আর প্রাচীণ মিশরীয়রা মনে করতো, বেবুন, তাদের শক্তিমান মৃতদের সঙ্গমশক্তির অধিকারী। বেবুনকে খুশী রাখতে পারলে পরজনমে তারা নারী সম্ভোগে বা রতিক্রিয়ায় পরিতৃপ্ত থাকতে পারবে। তাইতো তারা বেবুনের খাড়া লিঙ্গের প্রতিকৃতি বানিয়ে পরজনমে সঙ্গমক্রিয়ার সামর্থ পাবার আশায় বেবুনের প্রার্থনা করতো। সৌধের অপর একটি দেয়ালে দু’টি ছাগলাকৃতির মূর্তি যা তাদের ভাষায় দেবতা ‘খুম’ বা ‘খুম-রে’ সহ রাজলেখক ‘খনশু’ ও তার স্ত্রীর আসন করে বসা অবস্থায় ছবি পাওয়া গেছে। তারা দেবতা ‘অসিরিস’ ও ‘আইসিস’ এর কাছে প্রার্থনারত। অপর একটি দেয়ালে দেবতা ‘অরিসিস’ ও ‘আইসিস’কে বসা অবস্থায় পাওয়া গেছে। সৌধের ছাঁদও জ্যামিতিক নমুনায় আঁকা। অনেকটা দাবার বোর্ডের মত। সৌধের ভেতরের কক্ষ পাথরের টুকরায় ভরা। প্রত্নতত্ত্ববিদদের দৃঢ় বিশ্বাস আরো অনেক নতুন নতুন তথ্য অপেক্ষা করছে ওই গোপন কক্ষে এবং তারা পাথর সরিয়ে সেই কক্ষে যাবার রাস্তা না বের করে তাদের প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত করবেন না। দেয়ালে আঁকা ও খোদাইসহ আরও অনেক তথ্য পাওয়া যাবে বলে প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা। এসব কিছু আবিষ্কারের কৃতিত্ব ওয়াছেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের। (এনসিয়েন্ট এইজ থেকে অনুদিত)
লন্ডন: রোববার, ২২মাঘ ১৪২৩।।