দেবব্রত চক্রবর্তী
তত্ত্বগতভাবে ভারতের সংবিধান অনুযায়ী সমস্ত নাগরিক আইনের চোখে এক হলেও মুসলমানদের ক্ষেত্রে এই তাত্বিক অবস্থান বাস্তব অর্থে রাজ্যভেদে যে ভিন্ন ছিল তা প্রমাণিত হয় সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে । মুসলমানদের যেন ধরেই নেওয়া হয়েছে যে তারা এদেশীয় নন । তাদের আনুগত্য বিষয়ে সদা সন্দিহান মনোবৃত্তির ফলে ভারতের ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস মুসলমানদের জন্য প্রায় নিষিদ্ধ । ভারতের এবং পশ্চিমবঙ্গের সরকারী অ্যাডমিনস্ট্রেসানের উচ্চ পদে মুসলমান সংখ্যা অতি নগণ্য । শিক্ষা ক্ষেত্রের উচ্চ পদে মুসলমান অবর্তমান । ভারতীয় রেলে যত সংখ্যক মুসলমান কর্মরত তার ৯৭ % চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী।
পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা ঐতিহাসিক সময় থেকে হিন্দুদের তুলনায় সম্পদে, রাজনৈতিক ক্ষমতায় এবং শিক্ষায় পিছিয়ে থেকেছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে হিন্দুরা ছিল জমিদার আর মুসলমানেরা রায়ত এবং ভাগচাষী । কেবলমাত্র ১৯২০ থেকে ১৯৪৭ এর সময়ে অবিভক্ত বাঙলায় মুসলমান মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী হিন্দুদের কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে দাঁড় করাতে পেরেছিল । মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত কেন্দ্র এবং ব্রিটিশ প্রবর্তিত কিছু সংরক্ষণের সুবিধা, সাথে মুসলিম লীগের রাজনীতি তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতার কিছুটা পুনর্বিন্যাস করতে সক্ষম হয়েছিল, কিন্তু দেশ ভাগের পরে সমস্ত প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতৃত্বের এবং শিক্ষিত মুসলমান সম্প্রদায়ের দেশত্যাগের সাথে সাথে স্বাধীন সেকুলার ভারতবর্ষে ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণের পরিবর্তে চলে আসে জাতির ভিত্তিতে সংরক্ষণ।
যেহেতু মুসলমানরা তাঁদের ধর্মে জাতি বিভেদের অস্তিত্ব স্বীকার করেনা তাই এদেশে থেকে যাওয়া বিপুল পরিমাণ দরিদ্র মুসলমান সংরক্ষণের আওতার বাইরে চলে যায় । তার ওপর পূর্ববঙ্গ থেকে আগত শিক্ষিত হিন্দু উদ্বাস্তু এবং চাকরীর জন্যে তাঁদের মরিয়া প্রয়াস পশ্চিমবঙ্গে রয়ে যাওয়া তুলনামূলক কম শিক্ষিত মুসলমান যুবকদের কাছে চাকরীর বাজার ক্রমশ কঠিন করে তোলে । হিন্দু উচ্চ পদস্থ কর্মচারীদের হিন্দু প্রীতি বা সূক্ষ্ম মুসলমান বিদ্বেষ মুসলমানদের উচ্চ পদে উন্নীত হওয়ার এবং নূতন নিয়োগের ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
যেমন পশ্চিমবঙ্গে স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের পূর্বে সরকার অনুমোদিত স্কুলে নিয়োগের দায়িত্ব থাকতো স্কুল ম্যানেজিং কমিটির হাতে। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সমস্ত স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির নিয়ন্ত্রণ ছিল হিন্দুদের হাতে এবং সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গের স্কুলে মুসলমান ছাত্র থাকলেও মুসলমান শিক্ষক প্রায় ছিলইনা। যদিও পশ্চিমবঙ্গে সরকারী এবং বেসরকারি চাকরীর ক্ষেত্রে মুসলমানদের অনুপাত খুবই কম ছিল এবং বাকি সমস্ত সামাজিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলমানেরা পিছিয়ে ছিলেন কিন্তু না কংগ্রেস না বামফ্রন্ট কেউই সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের পূর্বে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের জন্য কোন রকমের সংরক্ষণ নিয়ে মাথা ঘামাননি। কিন্তু অন্যান্য রাজ্য যেমন কেরালায় মুসলমান জনসংখ্যা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় কম হওয়া স্বত্বেও ভারতের সংবিধানের আর্টিকেল ১৫(৪) এবং ১৬(৪ ) ধারা অনুসার তাদের রাজ্যে মুসলমানদের জন্য চাকুরি এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি ।
কেরালায় পাবলিক সার্ভিস কমিশনে ১২% মুসলমান কোটা এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে ৫০% মুসলমান এবং খ্রিস্টান কোটার কারণে সারা পশ্চিমবঙ্গের সরকারী চাকুরিতে বামফ্রন্ট জমানায় যখন মাত্র 3.4% মুসলমান কর্মরত ছিলেন তখন কেরালায় সরকারী চাকুরিতে মুসলমানের সংখ্যা 10.4%। পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত PSU তে একজনাও গ্রুপ এ পোস্টে মুসলমান না থাকলেও কেরালায় ৯,৫% মুসলমান PSU গুলিতে গ্রুপ এ তে কর্মরত। পশ্চিমবঙ্গের আইন বিভাগে মাত্র ৫% মুসলমান অথচ কেরালায় 12.3% মুসলমান আইন বিভাগে কর্মরত । যদিও কেরালার এই মুসলমান সংরক্ষণের পেছনে সেখানকার মুসলিম লীগের ( IUML) মত রাজনৈতিক দলের চাপ বর্তমান ছিল কিন্তু আমাদের রাজ্যে মুসলমানদের প্রতি এই ভয়ঙ্কর বৈষম্যের অন্যতম কারণ সংখ্যালঘু বিষয়ে আমাদের রাজ্যের সমস্ত রাজনৈতিক দলের বিপুল উদাসীনতা। ভদ্রলোক বাঙালীর সুপ্ত হিন্দু সাম্প্রদায়িক মানসিকতার উত্তরাধিকার বহন করে আসার ধারবাহিকতা। উদ্বাস্তু রাজনীতির প্রভাব, উচ্চ বর্ণের হিন্দু প্রভাবিত পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত রাজনৈতিক দলের মুসলমানদের প্রতি অসংবেদনশীলতা এবং মুসলমান স্বার্থ আদায় করার ক্ষেত্রে মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতি।
স্বাধীনতা পরবর্তী মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি বিভিন্ন ব্রাহ্মন্যবাদী রাজনৈতিক দলের যে উদাসীনতা, নির্লিপ্ততা সেই ধারাবাহিকতা মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার সুচারু রূপে বহন করে চলেছেন। সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে এবং এক দশকের বেশী সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরেও মুসলমানদের ওবিসি কোটা লাগু হওয়া স্বত্বেও পশ্চিমবঙ্গের মোট ৩,৩১,২৪৯ জন সরকারী কর্মচারীর মধ্যে মাত্র ১৮৯৯১ জন মুসলমান। অর্থাৎ মাত্র 5.73% মুসলমান রাজ্য সরকারের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত অথচ রাজ্যে মুসলমান জনসংখ্যা প্রায় ২৮%। ২০১২ সালের জুন মাসে পশ্চিমবঙ্গ পাবলিক সার্ভিস কমিশন বিভিন্ন বিভাগে নিয়োগের জন্য ৬৫১ জন সফল প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে তাদের মধ্যে মাত্র ২৩ জন ছিলেন মুসলমান অর্থাৎ সমস্ত সফল প্রার্থীর মাত্র 3.5%। পশ্চিমবঙ্গের সরকারী নিয়ম অনুসার ১৭% সিট ( ৭% বি ক্যাটিগরি ওবিসি এবং ১০% এ ক্যাটিগরি ওবিসি ) ওবিসি দের জন্য সংরক্ষিত। এই ৬৫১ জন নিয়োগযোগ্য প্রার্থীর মধ্যে সমস্ত ওবিসি প্রার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৬৯ অর্থাৎ 10.59% এবং তার মধ্যে মুসলমান ওবিসি’র সংখ্যা মাত্র ২ জনা অর্থাৎ 0.3% ।
কলকাতা পুলিশের ২৭,৩৮৮ জন কর্মচারীর মধ্যে মাত্র ২৫৮৫ জন মুসলমান কর্মচারী নিযুক্ত হয়েছেন, যা নিযুক্ত কর্মচারীর মাত্র 9.43%,। কলকাতা কর্পোরেশনের ক্ষেত্রে এই চিত্র আরও ভয়ঙ্কর, ২০০৭ সালে তৃনমূল যখন কর্পোরেশনের ক্ষমতা দখল করে তখন ৩৪,৭৩১ জন কর্মচারীর মধ্যে মাত্র ১৫৫৫ জন ছিলেন মুসলমান অর্থাৎ 4.47% বর্তমানে ২৭১২৫ জন কর্মচারীর মধ্যে মাত্র ১৩০১ জন মুসলমান যা সমস্ত কর্মচারীর মাত্র 4.79%। অর্থাৎ সংখ্যালঘু দরদী তৃনমূল বিগত ৯ বছরে কলকাতা কর্পোরেশনে মুসলমান কর্মচারী নিযুক্তি’র অনুপাত বৃদ্ধি করেছে মাত্র 0.32%।
সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের জমানায় পশ্চিমবঙ্গের সরকারী চাকুরীতে মুসলমানের অনুপাত ছিল ৮% এর মত, দীর্ঘ ৩৪ বছরের ব্রাহ্মণ্যবাদী বাম জমানায় চূড়ান্ত উদাসীনতার ফলে সরকারি চাকুরীতে মুসলমান জনসংখ্যার অনুপাত নেমে আসে মাত্র 3.4%এ। বর্তমানে সরকারী চাকুরীতে মুসলমানদের জন্য ১০% ওবিসি কোটা থাকলেও সরকারের উদাসীনতা, গাফিলতির কারনে মাত্র 0.3% সেই কোটার সুবিধা পায় আর সেই কারনেই আজকে এক দশক পরে মাত্র 5.73% মুসলমান রাজ্য সরকারের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত। এখন কেরল যদি এই বিষয়ে সচেতন প্রয়াস নিতে পারে, সংবিধানের আর্টিকেল ১৫(৪) এবং ১৬(৪ ) ধারা ব্যবহার করে রাজ্যে মুসলমানদের অবস্থার উন্নতির চেষ্টা করতে পারে তাহলে আমাদের রাজ্যে -কংগ্রেস -বামফ্রন্ট -তৃণমুল পারেনা কেন?
শত দুর্বলতা স্বত্বেও গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা যেমন নেপালি সংখ্যালঘুদের স্বার্থে এক প্রেশার গ্রুপ হিসাবে কাজ করছে অথবা কেরলে’র মুসলিম লীগ মুসলমানদের দাবীর সমর্থনে কখনো সিপিআই(ম ) কখনো কংগ্রেসের সাথে মিলে নিজেদের দাবী আদায়ে চাপ সৃষ্টি কারি এক রাজনৈতিক সংগঠন। হয়ত ঠিক তেমনই পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা দীর্ঘ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানে সুবিধাবাদী এবং উদাসীন সুপ্ত সাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মণ্যবাদী কংগ্রেস এবং সিপিআই (ম ), তৃনমূলের ছদ্ম ধর্মনিরপেক্ষতার ছাতার বাইরে বেরিয়ে এসে গড়ে তুলবেন নিজেদের সক্ষম রাজনৈতিক সংগঠন। হয়ত কোনদিন স্বাধীনতা পূর্ব বাঙলার মত পশ্চিমবঙ্গের ২৭-২৯% মুসলমান এবং ২৩% নমশূদ্রদের জোটের রাজনীতি সাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চবর্ণ নিয়ন্ত্রিত পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে । কিন্তু ততদিন তহ্বা সিদ্দিকি, ইমাম ভাতার সস্তা রাজনীতি একটি কি দুটি পূর্ণ বা প্রতিমন্ত্রীর টোপ এবং বিবিধ কুনাট্য পশ্চিমবঙ্গের প্রায় এক তৃতীয়াংশ বাসিন্দাদের দুর্ভাগ্য জনক ভবিতব্য হিসাবে রয়ে যাবে।