হারুনূর রশীদ।।
একই গল্পের বহু নমুনায় বর্ণনার রীতি মনে হয় আদিকাল থেকেই চলে আসছে। ছোটবেলায় ওয়াজ শুনেছি অগনিত। ওই সময় আমাদের এলাকায় কিশোর বয়সিদের নিষ্কলুষ আমোদ-প্রমোদের কোন ব্যবস্থাই ছিলনা। শুধুমাত্র ফুটবল ছিল, কিন্তু সে ছিল শুধু বড়দের জন্য। আমরা ছোটরা আমার মামাদের বীজচারাতে ‘ননদাইর’ ও ‘গাইয়াগুটি’ খেলে অবসরের বিনোদনে সময় কাটাতাম। মেয়েরা বাড়ীর ভেতরেই ‘বন্ধী’ বলে একটি খেলা খেলে সময় কাটাতো। খেলাটি বেশ মনযোগ আকর্ষণ করার মতই। এখনও গ্রামে-গঞ্জে গেলে, বাড়ীতে ছোটদের এই বন্ধী খেলতে দেখা যায়।
খেলাটির নাম বন্ধী হয়ে উঠার পেছনে আমাদের অতীতের রাজা-বাদশাহী আমলের সংস্কৃতি জড়িত রয়েছে বলেই মনে হয়। ক্রিকেট খেলায় যেভাবে বল ছুড়ে দেয়ার সাথে সাথে দু’দিকের দু’জন ‘ব্যাটসম্যান’ প্রানপণে দৌড় শুরু করেন ‘রাণ’ নেয়ার তাগিদে, ঠিক তেমনি ‘বন্ধী’ খেলায়ও দু’দিকে দু’জন থাকেন। একজন একটি গোলাকৃতি বা চতুর্ভুজ দাগের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকেন। তাকে বলা হয় রাজা বা রাণী। ক্রিকেটের মতই রাজার অনতিদূরে থাকে রাজার পক্ষের তাবু। সেখানে রাজার লোকজন ‘ডাক’ দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। খেলার নিয়ম হলো, রাজার লোকজন ডাক দিয়ে বিপরীতপক্ষের লোকজনকে দৌড়াতে থাকে সেই ফাঁকে রাজাকে দৌড়ে নিরাপদে তার তাবুতে যেতে হবে। এই যাবার পথে বিরুধীপক্ষের কেউ যদি ছুঁয়ে দেয় তা’হলেই রাজা মারা পড়েন। রাজাকে ছুঁতে পারলেই খেলায় জিত। রাজাকে এই ছুঁয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে ঘিরে রাখে ভিন্ন পক্ষের সেপাইরা। ‘ডাক’ দিয়ে তাদের দৌড়াতে হয় রাজাকে তার নির্ধারিত ঘর থেকে বের হয়ে তার মূল ঘরে নিরাপদে যাবার জন্য। দলপতি ঠিক করে দেবেন কে কখন ‘ডাক’ দেবে। এই ‘ডাক’ নিয়ে রাজার কাছে এসে রাজাকে স্পর্শ করে বেশী কাছে দাঁড়িয়ে থাকাদের দৌড়াতে হয়। দৌড়ানোর সময় শ্বাস ছাড়তে পারবেন না। শ্বাস ছেড়ে দিলে তিনি মারা পড়বেন। রাজা-বাদশাহীর একটা অতি প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন করে আসছে এ খেলাটি। আমাদের রাজ-রাজন্যগন যে একসময় একে অন্যের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লেগেই থাকতেন এ ইতিহাসই খেলাটির মধ্য দিয়ে আমরা অনুধাবন করতে পারি।
আমাদের বাড়ীর একেবারে কাছ দিয়েই পাহাড়ীকন্যা মনু প্রবাহিত। মনুর সেই যৌবন আমরা দেখেছি যা আজ আর নেই। সে আরেক কাহিনী বলতে গেলে। এই মনুতীরে নদীর ঘাট ছিল। সে ঘাটে কত না দূর দেশ থেকে এসে নৌকা ভিড়তো। মৌসুমের কোন কোন সময় একসাথে ৮-১০খানা নৌকাকে ঘাটে নোঙ্গর করে মাসের মত সময় বসে থাকতে দেখেছি। জানা অজানা দূরের কত দেশ-গাঁ থেকে মাটির বাসন-কোসন নিয়ে নৌকায় দলবেঁধে নাইয়ে ব্যবসায়ী বা ছোট সওদাগরেরা আসতো। গাঁয়ে গাঁয়ে বাড়ী বাড়ী হেঁটে এসব বিক্রি করতো। আরেক পক্ষ নাইয়েরা আসতে দেখেছি যারা ধান কিনে নিতো। মনুর এ ঘাটের জৌলুসের সেদিন আজ আর নেই। এখন আর সেখানে কোন নায়ের হাট বসেনা। ঘাটই নেই বরং গড়ে উঠেছে মাথাছোঁয়া নদীর বন্যা বাঁধ। অতীতের পাকিস্তানী আমল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ আমল পর্যন্ত সরকারগুলোর দায়ীত্বহীনতা নদীভাঙ্গনকে এতই তরান্বিত করেছে যে কয়েক কেদার জমির পরে থাকা বৃটিশদের তৈরী বড় সড়ক ভেঙ্গে নদীতে বিলীন হয়েগেছে। কত বাড়ী-ঘর গ্রাম নদীগর্ভে জীবনের মত হারিয়ে গেছে সে খুবই দুঃখভরা করুন ইতিহাস। বাঁধ দেখে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না যে এখানে একসময় বিস্তীর্ণ খোলা ক্ষেতের মাঠ ছিল। মাঠের পেছনেই বাড়ী-ঘর ছিল। মানুষের কল-কাকলিতে মুখরিত থাকতো সকাল-বিকেল-সন্ধ্যে। মৌসুমের সময় প্রতিনিয়ত নৌকার আনা-গোনা থাকতো। ব্যবসায়ী নাইয়েরা ৩-৪মাইল দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে পায়েহেঁটে শত শত মন ধান কিনে নিয়ে নৌকায় তুলার জন্য ঘাটে নিয়ে আসতো। পাল তোলা নৌকা এসে ঘাটে ভিড়ার সাথে সাথেই আমাদের আব্দুর রহমান খাঁদের বাড়ী সরগরম হয়ে উঠতো ভিনদেশী মানুষের আনা-গোনায়। (আরো আছে)
লন্ডন, বুধবার
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭